শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমি আমার গুরুকে হারালাম

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন পেলাম, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আর নেই। ঘুমের ঘোরে বুঝতে কষ্ট হলো। তারপর বন্ধুটি যতটা জানেন, ততটা বললেন। তখন থেকেই ভেবে চলেছি জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার বিভিন্ন কারণে সম্পৃক্ততার কথা।

স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয় ১৯৬৮-এর শেষে কিংবা ৬৯-এর প্রথমে। আমি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আমাদের তখন সার্ভেয়িংয়ের ওপরে অ্যাডভান্স কোর্সটি সম্পন্ন করার জন্য ঢাকার বাইরে কোনো জায়গায় ক্যাম্পে থেকে হাতেকলমে কাজ শেখার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জন্য গাজীপুরের তখনকার টেলিফোন বিভাগের একটি জায়গা নির্বাচন করল। একটা বড় এলাকা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। দুটি সুউচ্চ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। ছোট্ট একটি অফিস। বিরাট ফাঁকা এলাকা। শিক্ষকদের বড় বড় তাঁবু পড়ল এক পাশে, আর ছাত্রদের তাঁবু পড়ল আরেক পাশে। সকাল সাতটায় শিক্ষকেরা সমবেত হয়ে ছাত্রদের হাতেকলমে কাজের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। সেখানেই উদিত হন ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরী। বিদেশ থেকে কেবল ফিরেছেন। খেলোয়াড়সুলভ আচরণ। ছাত্রদের ভাগ করে বিভিন্ন শিক্ষকের অধীনে ন্যস্ত করা হলো। আমি পড়লাম জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাগে।

সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন। নির্দেশনাবলি পরিষ্কার। প্রায় এক মাস ধরে এই ক্যাম্পে থাকার সময়ে যথেষ্ট নৈকট্য লাভ করেছি। বছরখানেক পরে পাস করে গেলাম। বুয়েটে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হলাম। স্যারের সঙ্গে প্রায়ই কথাবার্তা হতো। এরপর ১৯৭২ সালে শিক্ষক হিসেবে পুরকৌশল বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দিলাম।

আমিসহ আরও তিনজন লেকচারার। আমরা কিছু শিক্ষকের ক্লাসের দায়িত্ব নিয়ে নিয়ে তাঁদের ওপর চাপ কমালাম। আমি পেলাম জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি ডিজাইন ক্লাস। স্বাভাবিকভাবেই আমি তাঁর দ্বারস্থ হলাম, কীভাবে পড়াব সে বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য। যেহেতু একই বিভাগে শিক্ষকতা করছি, প্রতিদিনই অবশ্যই দেখা হতো, বিভিন্ন বিষয়ে কথা হতো। আর সাধারণত রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে কথা বলতে চাইতেন না। খেলাধুলায় তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। কিন্তু নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট ও টেবিল টেনিস দলের সদস্য ছিলেন।

আমাদের মধ্যে অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিষয়ে কথা হতো। জামিলুর রেজা চৌধুরী পুরকৌশলের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আর আমি ঢুকলাম পানিসম্পদ কৌশল বিষয়ের শিক্ষক হয়ে। একসময় পুরকৌশল থেকে পানিসম্পদ কৌশল নতুন বিভাগ হিসেবে সৃষ্ট হলো। আমি বাধ্য হলাম পানিসম্পদ কৌশল বিভাগে চলে যেতে। কিন্তু স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আগের মতোই ঘনিষ্ঠ রইল।

আমি স্যারের সঙ্গে অনেক প্রকল্পে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছি। বাংলাদেশে সাইক্লোন শেল্টারের মাস্টারপ্ল্যান, যমুনা সেতুর পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং একইভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। আমি জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সব্যসাচী প্রকৌশলী হিসেবে বর্ণনা করে তাঁকে প্রদত্ত কয়েকটি সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা দিয়েছি। সব্যসাচী শব্দের অর্থ বোধ করি সব বিষয়ে পারদর্শী অথবা যিনি ডান হাত এবং বাঁ হাত—দুই হাতেই এক সমান শক্তি দিয়ে কাজ করতে পারেন। জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বিচরণের বেলায় জামিলুর রেজা চৌধুরী অবশ্যই সব্যসাচী হিসেবে গণ্য হতে পারেন।

তাঁর মূল বিষয় ছিল উঁচু ভবন নির্মাণ। কিন্তু সেখান থেকে পুরকৌশলের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আর সেতু নির্মাণ ইত্যাদিতে তাঁর সমান দক্ষতা ছিল। সাইক্লোন শেল্টার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময় তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মনোনিবেশ করেন। এবং পরে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস ব্যবস্থাপনা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু নির্মাণে নদীশাসন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্বটা আমার থাকলেও বহু সময়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে গাইড করতেন। প্রকৃতি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁর অনেক আগ্রহ ছিল। ইতিহাসে ছিল অগাধ আগ্রহ। প্রকৃতি সংরক্ষণেও তিনি ভূমিকা রেখে গেছেন।

যেকোনো জার্নাল হাতের কাছে পেলেই খুব দ্রুত তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নিতেন। জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি অবিস্মরণীয় গুণ ছিল, তা হলো মনে রাখার ক্ষমতা। একবার কোনো কিছু পড়লে তা আর ভুলতেন না। ৩০-৪০ বছর আগে পড়া প্রবন্ধ তিনি চট করে মনে করতে পারতেন। তাঁর একই ধরনের গুণ ছিল মানুষের চেহারা ও তার পরিচিতি মনে রাখার বেলায়। কাউকে একবার দেখলে এবং তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলে বহুদিন পরেও তাঁকে মনে করতে পারতেন।

আমি বিভিন্ন সময়ে একান্তে বহু সময় তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি। যমুনা সেতু নির্মাণকালে প্যানেল অব এক্সপার্টসের সদস্যরা সেতু প্রকল্পের পূর্ব পারে রেস্টহাউসে একসঙ্গে দুই থেকে তিন দিন কাটাতাম। প্রতি মাসেই একবার–দুবার মিটিং করতে হতো। পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময়ও আমরা একইভাবে নদীর পশ্চিম পারের রেস্টহাউসে একনাগাড়ে তিন দিন করে কাটিয়েছি। মিটিং চলার সময়ের বাইরে বিকেলে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছি। আমি আগেই বলেছি, তিনি রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে মতামত রাখতেন না। কিন্তু বুঝতে পারতাম যে এ বিষয়ে তাঁর পরিষ্কার মতামত আছে।

তিনি বাংলাদেশে আরেকটি বড় কাজ করেছিলেন কম্পিউটার প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য। তিনি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের প্রথম পরিচালক ছিলেন। মানুষের জন্য কম্পিউটারকে সহজলভ্য করার জন্য সরকারকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিতেন। এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করত।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর চরিত্রের একটা বিশেষ দিক আমাকে আকর্ষণ করত। সেটা হচ্ছে, যে বিষয়ে কনভিন্স হতেন, সে বিষয়টি থেকে সহজে সরে আসতেন না। ধীরস্থিরভাবে যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন। যমুনা সেতু প্রকল্পের বেলায় দেখেছি, যখন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা সেতুর প্রয়োজনীয়তা নাকচ করার জন্য বিভিন্নভাবে তর্ক করতেন, উনি তখন অর্থনীতিবিদ না হয়েও অর্থনীতিবিদের মতো যুক্তিতর্ক তুলে ধরতেন। এ জন্য অর্থনীতির বহু জিনিস তাঁকে গোড়া থেকে পড়ে নিতে হয়েছে।

স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্রপাত হয় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাধ্যমে। তারপরে হয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক এবং নতুন শিক্ষকের সম্পর্কের মাধ্যমে, পরবর্তীকালে হয় বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুবাদে। তিনি কারিগরিভাবে যে কাজগুলো করতেন, তার জটিল বিশ্লেষণগুলো নিজে বুঝেই এগোনোর চেষ্টা করতেন। তাঁর লেখার হাত ছিল চমৎকার। সহজে যেকোনো সিদ্ধান্তকে গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারতেন। তাঁর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত কয়েক শ মিটিংয়ে যোগ দিয়েছি বললে অত্যুক্তি হবে না। মিটিং পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা এবং সভার শেষে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো গুছিয়ে সারমর্ম করায় তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্যারকে আমার গুরুর মর্যাদা দিতাম। কাজেই জামিলুর রেজা চৌধুরীর তিরোধানে আমি আমার একজন গুরুকে হারালাম—এটা লিখতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

আইনুন নিশাত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক