আমানতকারীরা কেন আস্থা পাচ্ছেন না

ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর চলতি অর্থবছরের জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন। তফসিলি ব্যাংকে রক্ষিত মোট আমানতের পরিমাণ এবং আমানতের ওপর প্রদত্ত গড় সুদের হারের সম্পর্ক দেখলে উত্থান-পতন লক্ষ করা যাবে। দেখা যাবে, সুদের হার বাড়লেও আমানতের পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েছে। তাহলে কি এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে যে সুদের হার যা–ই থাকুক, মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখবেই! বলা হয়ে থাকে, সুদের হার ও আমানতের মধ্যে সম্পর্ক আছে। তা–ই হওয়ার কথা। তবে শুধু এ দুটো চলক নিয়েই আন্তসম্পর্ক খুঁজলে আলোচনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুদের হার ও আমানতের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণে নিয়ামক চলক তথা আমানতের নিরাপত্তাবিষয়ক ভাবনাকে অন্তস্থ করে সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। আস্থার সংকট হলে আমানত কমে যাবে। আরেকটি কথা চালু আছে, হুকুম জারি নয়, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদের হার নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে হুকুমজারি যেমন কাজ করবে না, একইভাবে বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুদের হারও নির্ধারিত হবে না। সমস্যা যে কারণ থেকে উদ্ভূত, সমাধান তার মধ্যেই নিহিত। খেলাপি ঋণ থেকে অসুখের উৎপত্তি, নিরাময়ও খেলাপি ঋণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

 ২. 
ব্যাংক আমানতকারীদের প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের বিনিয়োগের প্রায় ৯৫ শতাংশই আমানতকারীদের অর্থ। ব্যাংক থেকে প্রদত্ত ঋণ আমানতকারীদের টাকা। দেখা যাচ্ছে, আমানতকারীদের প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো গোষ্ঠীতন্ত্রে আটকে গেছে। খেলাপি ঋণের বিপুল পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করেই আমানতের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হওয়ায় আমানতকারীদের স্বার্থ বিনষ্ট হচ্ছে। 

মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪ শতাংশ খেলাপি ঋণ—দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ২২ শতাংশের ওপরে। সরকার ধারণা দিয়েছিল যে ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন ছাড় এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা সমাধান করা যাবে। ঋণ পুনঃ তফসিল ও এককালীন পরিশোধসংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ এককালীন জমার বিপরীতে ১০ বছরের জন্য পুনঃ তফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ সুদহার ধরা হয়েছে ৯ শতাংশ। আবার ব্যাংক চাইলে পুনঃ তফসিলের আগে সুদ মওকুফ সুবিধাও দিতে পারবে। ঋণ পুনঃ তফসিল ও এককালীন পরিশোধ করা খেলাপিরা নতুন করে ঋণ সুবিধা নিতে পারবেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এত সব ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও সমস্যার সমাধান না হয়ে দিন দিন পরিস্থিতি প্রকট হচ্ছে। এ নীতিমালা ব্যাংকিং খাতের রুগ্‌ণ দশা সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ হলেও অর্থমন্ত্রী অধিকন্তু বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কার্যকর করার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের মাফ করার প্রক্রিয়া শুরু করবেন বলে সংসদে জানিয়েছেন। 

একটি মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী আমানতকারীদের টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। আবার ঋণ পুনঃ তফসিলের ভার জনগণ তথা আমানতকারীদের ঘাড়েই চাপছে। সরকারি ব্যাংকে জনগণের করের টাকায় মূলধন ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকের মূলধন–সংকট মেটাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা জনগণপ্রদত্ত কর থেকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ করের টাকায় এ ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। অন্য দিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে গড়ে ৬৮ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য ও পরিমাণ দেখানো এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে কম মূল্য ও পরিমাণ দেখানোর মাধ্যমে পুঁজি পাচার ঘটছে। কয়েক বছর ধরে পাচার করা টাকার একটি অংশ এভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। 

 ৩. 

সমস্যা সত্ত্বেও পুনঃপুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে কেন? মূলত এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টনের মধ্যে। ব্যাংকের উদ্যোক্তারা মাত্র ৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে বিপুল পরিমাণে মুনাফা আদায় করেন। মোটাদাগে, প্রদত্ত ঋণের সুদ, বিভিন্ন পরিষেবার ফি আদায় এবং ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো অর্থোপার্জন করে। ঋণের বিপরীতে বেশি সুদ গ্রহণ করে আমানতের বিপরীতে স্বল্প সুদ দেওয়ায় ব্যাংকগুলোর স্প্রেড হার বেশি। ফলে মুনাফার পরিমাণ বেশি। অন্য দিকে অভিযোগ আছে, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় কারসাজি করে প্রতিবছর আয় দেখানো হয়। যেমন বিপুল পরিমাণ খেলাপি এবং খেলাপিযোগ্য ঋণকে অখেলাপি দেখিয়ে ওই ঋণের ওপর আরোপিত সুদকে আয় হিসাবে দেখানো হচ্ছে—যা বিধানের বরখেলাপ। এ ধরনের কারসাজির কারণে সাময়িকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আয় বেড়ে যায়। ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এক ব্যাংকের পরিচালকেরা আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। তাঁরা আবার রাষ্ট্রক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। এ রকম বন্দোবস্তে একে অপরের রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।

ব্যাংকগুলো অর্থ ও সম্পদ তৈরি করতে পারছে না। খেলাপি ঋণের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের জড়িত থাকার খবর মিলছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে পরিচালনা পর্ষদের কাঠামোতে আরও সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই পরিবার থেকে চারজন কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারবেন। একই সঙ্গে পরিচালক পদে টানা থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে ৯ বছর করা হয়েছে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো যে প্রকৃতপক্ষে আমানতকারীদেরই প্রতিষ্ঠান, সে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ফলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। 

 ৪.

পুঁজির সঞ্চয়ন থেকেই প্রবৃদ্ধি আসে। ব্যাংক পুঁজি সঞ্চয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে। ব্যাংকগুলো মূলত ব্যক্তি খাতে অর্থ সৃষ্টির দ্বারা পুঁজি সঞ্চয় করে এবং অর্থ সরবরাহের দ্বারা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ায়। ফলে অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। পুঁজির সঞ্চয়ন ও উৎপাদনশীলতা প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রাখে। 

এক দিকে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, অন্য দিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার সরকার ব্যাংক খাত থেকে অত্যধিক ঋণ নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণযোগ্য টাকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। অর্থবছরের ৬ মাসের মধ্যেই সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ঋণ নিয়েছে ৫১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার ছয় মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো পড়েছে তারল্যসংকটের দশায়। তাই ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। এর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে। কয়েক বছর ধরেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশের মধ্যেই আটকে আছে।

 ৫. 

আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার সুযোগে অর্থনীতিতে অর্থপ্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনুসন্ধান প্রয়োজন, অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত অর্থপ্রবাহ চালু রাখতে কী করতে হবে। এ জন্য প্রথমেই ব্যাংকের সঙ্গে আমানতকারীদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ব্যাংকিং একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাত। মূলত উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ বলেই আস্থা ব্যাংকিং খাতের বনিয়াদ। ঝুঁকি হ্রাসের মাধ্যমেই কেবল আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা আস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না; বরং গোষ্ঠীতন্ত্র ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ফলে আমানতকারীদের ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা না গেলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না, আস্থাও তৈরি হবে না। 

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে পুঁজির সঞ্চয়নে বিপ্রতীপ অভিঘাত পড়বে। ফলে প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার প্রয়োজন। ব্যাংকের প্রকৃত মালিক হলেন আমানতকারীরা। ইতিহাসের আলোকে দেখা গেছে, সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর হয় না এবং সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটে না। ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ তথা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাই আমানতকারীদেরও এগিয়ে আসা দরকার। 

 ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন 

rt@du.ac.bd