ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ! এটাই তো বাংলাদেশ। একজনের বিপদে চিরকাল দশজন এগিয়ে এসেছে। সেই দেশে মানুষ এত নির্বিকার হয়ে গেল কীভাবে? আমরা তো আমাদের ছাত্রাবস্থাতেই মানুষকে কত সক্রিয়-সংবেদনশীল আর মানবদরদির ভূমিকায় দেখেছি। ১৯৮৮ সালে বন্যা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আমরা দিনরাত ব্যস্ত ছিলাম রুটি বানাতে, স্যালাইনের প্যাকেট তৈরিতে। জাতীয় কবিতা পরিষদের হয়ে চাঁদা তুলেছি, ত্রাণ তহবিল গঠন করে নৌকা নিয়ে চলে গেছি বন্যা উপদ্রুত এলাকায়, মানুষের হাতে কিছু একটা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ‘আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি’—এই ছিল প্রত্যেকের ব্রত এবং সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসকে একত্র করার আয়োজন ছিল। ফয়েজ আহমদ ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতা, তাঁর নেতৃত্বে অহোরাত্র পরিশ্রম করতেন সংস্কৃতিকর্মীরা। ছাত্রসংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাধ্যমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মনে আছে, জগন্নাথ হলের হলরুমের ছাদ ধসে যাওয়ার সময়কার কথা, সারা ঢাকা শহরের মানুষ ছুটে এসেছিল উদ্ধারকাজে অংশ নিতে।
কিন্তু বাংলাদেশে আজ কী হলো যে মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসে না! দেশের অনেক এলাকায় বড় বন্যা হয়ে গেল, অনেক জায়গায় পানি নেমে গেলেও মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। কৃষির ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষের নিরাপদ তন্দ্রা টলল না। ফেসবুকে কুড়িগ্রামের বন্ধুরা, গাইবান্ধার বন্ধুরা একাকী রোদন করে যাচ্ছেন।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তো আজও আছে। শিক্ষালয়গুলোতে ছেলেমেয়েরা গিজগিজ করছে। ছাত্রসংগঠনগুলোও আছে তো। রাজনৈতিক সংগঠন আছে। এনজিও আছে। কিন্তু দৃশ্যমান সম্মিলিত উদ্যোগ-আয়োজন নেই।
আছে বিচ্ছিন্ন চেষ্টা। ‘বন্যাকবলিত মানুষের পাশে লেখক সমাজ’ নাম দিয়ে লেখকেরা একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা কয়েক লাখ টাকা নিজেরা চাঁদা দিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন কুড়িগ্রামের বন্যার্ত মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। কিন্তু বড় রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কোনো স্বতঃপ্রণোদিত বড় উদ্যোগ অন্তত আমার চোখে পড়েনি। এই ধরনের উদ্যোগে বন্যার্ত মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়, তা বলি না। কিন্তু মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, এই দৃশ্যে মনে হয়, আশা আছে। মানবিকতা শেষ হয়ে যায়নি। একজনের দেখাদেখি আরেকজন এগিয়ে আসে। যথাযথ কর্তৃপক্ষেরও টনক নড়ে। তারা তাদের কর্তব্য সম্পর্কে আরেকটু বেশি সচেতন হয়।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপে রাজধানী কুপিত। এখন সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী আছে, অনেক জেলাতেই এডিস মশার উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। একটা এলাকায় যদি ডেঙ্গু রোগী থাকে, কিন্তু এডিস মশা না থাকে, সেখানে ডেঙ্গু রোগ ছড়াবে না। একটা জায়গায় যদি এডিস মশা থাকে, কিন্তু কোনো ডেঙ্গু রোগী না থাকে, তাহলেও এই রোগের বিস্তার ঘটবে না। কিন্তু যেখানে ডেঙ্গু রোগীও আছে, এডিস মশাও আছে, সেখানে এই রোগের বিস্তার রোধ করা খুবই কঠিন। আমরা তো ডেঙ্গু রোগী নির্মূল করতে পারব না, এডিস মশা নির্মূল করতে হবে। রাস্তায় ফগমেশিনের ধোঁয়া ছড়িয়ে এডিস মশা নির্মূল করা কঠিন। আর ওষুধে যদি ভেজাল থাকে বা মশা যদি ওই ওষুধ সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করে থাকে, তাহলে ওষুধ দেওয়ার চেয়ে না দেওয়াই ভালো। এডিস মশা নির্মূলের কাজটা তাই গৃহবাসীকেই করতে হবে। নিজেদের ঘরে ফুলদানির পানি, ফ্রিজের পেছনের পানি, টবের নিচের পানি আমরা পরিষ্কার করছি তো! ছাদে, বাড়ির পেছনে, দুই বাড়ির ফাঁকে কোথাও পানি জমছে না তো! ফেলে রাখা টায়ারে, ডাবের খোসায়, পাত্রে পানি জমে থাকছে না তো! এটা দেখার কাজ নাগরিকদের। একটা ডাকের মতো ডাক দিলে নাগরিকেরা এটা করবেন না? কিন্তু সেই আহ্বান কেউ দিলেন না। যাঁরা দেন, তাঁদের কথা কেউ শোনে না। বিকল্প হলো, ভ্রাম্যমাণ আদালত নামিয়ে সাজা দেওয়া। এটা শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম আরও জোরদার করা হোক। প্রচার করুন বেশি বেশি করে। স্বেচ্ছায় যদি আমরা এগিয়ে না আসি, তাহলে শাস্তির ভয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হোক। দুশ্চিন্তার কথা হলো, সারা দেশে এডিস এবং ডেঙ্গু ছড়ালে মহামারি হয়ে যাবে। তার আগেই এই রোগ নির্মূল করতে হবে। জেলায় জেলায় এডিস মশাবিরোধী অভিযান শুরু করতে হবে। তাতে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে জনগণকে।
কিন্তু জনগণকে তো উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। কেন এমনটা হলো? আওয়ামী লীগের নেতা মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমাকে এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের মিছিলে লোক হয় না কেন, জানেন? কারণ, দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে। প্রত্যেক মানুষের সম্পদ হয়েছে, সন্তানের জন্য ভবিষ্যতের একটা ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাস্তায় মিছিল করে জীবন দেওয়ার মতো লোক আর পাবেন না।’ সেই কথাটা আমার বারবার মনে পড়ে।
কিন্তু নিজের সন্তান যখন ডেঙ্গুর মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে, তখন মানুষ তাকে রক্ষা করতে সামান্য কিছু কাজ করতে এগিয়ে আসবে না? দেশটার হলোটা কী?
এখানে মনে পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন’। পঞ্চাশের মন্বন্তরে মানুষ রাস্তায় অনাহারে মারা গেছে, কিন্তু হোটেলে সাজানো খাবার ছিনিয়ে খায়নি। কেন? ওই গল্পে বলা হয়েছে, কারণ ছিনিয়ে খাওয়ার জন্য যতখানি শারীরিক বল দরকার ছিল, মানুষের তা-ও ছিল না। না খেতে খেতে তারা সেই উদ্যম-আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে সাড়া নেই দেখে আমি ভাবি, আমাদের সব উদ্যম কি শুষে নেওয়া হয়েছে! আমরা কি প্রতিবাদ করার শক্তি ও বোধও হারিয়ে ফেলেছি?
একটা সহজ হিসাব আপনাদের দিই। ২০১৮ সালের নভেম্বরেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জানিয়েছেন, এক বছরে কাজের সন্ধানে বিদেশে গেছে ১০ লাখের বেশি লোক। এ দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাড়ে; তাদের মধ্যে ১০ লাখ যদি বিদেশে চলে যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় প্রায় সব পুরুষই বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর যারা আছে, তারাও বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। আরেক হিসাবে বলা হচ্ছে, প্রতিবছর বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী। আর আজকের তরুণেরা বড় বেশি ক্যারিয়ার-মগ্ন। বইমেলায় গল্প-উপন্যাস-কবিতার বইয়ের চেয়ে বেশি বিক্রি হয় ক্যারিয়ার গঠনের বই।
জরিপে বলা হচ্ছে, এ দেশের বেশির ভাগ তরুণ বিদেশে চলে যেতে চায়। দেশ পরিচালনার কার্যক্রমে তরুণদের অংশগ্রহণের, মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। পরপর দুটো নির্বাচন প্রায় একপক্ষীয় হওয়ার ফলেও জনগণ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারে। আবার মানুষের সামনে কোনো বিকল্পও নেই। সবটা মিলিয়ে নাগরিকদের মধ্যে হতাশা, নিষ্ক্রিয়তা। এটা ভালো লক্ষণ নয়।
তবু আশা আছে। আমার বাসায় এসেছিল সাতজন ছাত্রছাত্রী। তারা পড়ে ঢাকার সানিডেল স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে। অর্পা, অর্থী, নাফিজ, নাজিফ, আয়েশা, মাইসুন, রাহদ্বীন। তারা একটা সংগঠন করেছে—ইচ্ছেঘুড়ি। তারা ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় কী, বোঝানোর চেষ্টা করছে মানুষকে। আমাকেও বোঝাল। আমাদের গৃহকর্মীকে বোঝাল। এদের মধ্যে অর্থী আবার আমার বই ক্ষুধা এবং ভালোবাসার গল্প পড়েছে। তারা উদ্বিগ্ন, মঙ্গাপ্রবণ এলাকায় কী করে মানুষের ভাগ্য বদলানো যায়। গরিব মানুষকে কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়। এদের এই বেদনাটুকু খাঁটি। আমি আবারও আশায় বুক বাঁধলাম।
কিন্তু আমি জানি, এই ছেলেমেয়েরা বিদেশে চলে যাবে। এবং আমি জানি, কিশোর-তরুণদের বেদনাগুলোকে কঠোরভাবে দমন করা হবে। যেমনটা করা হয়েছে নিকট অতীতে।
নিজের কবিতা নিজেকে শোনাব?—মানুষের জাগরণে আস্থাহীন হয়ো না মানুষ। মানুষ জাগবে ফের।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক