মতামত

আমাদের স্বাধীনতা কি মনের মুক্তি ঘটিয়েছিল?

নতুন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ একাত্তরের জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল
নতুন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ একাত্তরের জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল

সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০) ছবিতে মূল চরিত্র সিদ্ধার্থকে যখন চাকরির ইন্টারভিউয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘তোমার মতে ষাট দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোনটি?’ সিদ্ধার্থ বলেছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা। তার মনে হয়েছিল, সেই দশকে চাঁদে মানুষের অবতরণের চেয়েও ভিয়েতনামের যুদ্ধে সাধারণ মানুষের দেখানো সাহস বিস্ময়কর।

কারণ, প্রযুক্তির অগ্রগতিতে চাঁদে যাওয়া অচিন্তনীয় ছিল না। কিন্তু পরাক্রমশালী মার্কিন সামরিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রবল সাহস ভিয়েতনামের কৃষকদের আছে, তা কেউ ভাবেনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণমানুষের নির্ভীক প্রতিরোধ দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশেও। যে গণযুদ্ধের মাধ্যমে ৫০ বছর আগে আমরা মাতৃভূমি স্বাধীন করেছিলাম তা ছিল প্রবল ক্ষমতাধর এক সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সাহসী সংগ্রামের অবিস্মরণীয় ঘটনা।

স্বাধীনতা অর্জনের পর জনগণের মনে তৈরি হয় সমাজ নতুনভাবে গড়ে তোলার গভীর আকাঙ্ক্ষা। সেই সময় ভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চর্চা প্রবর্তনের মাধ্যমে নাগরিকদের মনে সম্পূর্ণ নতুন চেতনা সৃষ্টি করা জরুরি। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজটিই ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে করা হয়নি।

বিখ্যাত ঔপনিবেশিকতাবিরোধী ছবি ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ (১৯৬৬)-এর একটি দৃশ্যে ফরাসিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত আলজেরিয়ার গেরিলা সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (এফএলএন) এক নেতা বেন মেহেদি সংগঠনের একজন তরুণ কর্মীকে বলেন, ‘একটি বিপ্লব শুরু করা কঠিন, আরও কঠিন সেই বিপ্লব ধরে রাখা এবং তার চেয়েও কঠিন হলো বিপ্লবে বিজয়ী হওয়া। তবে সবচেয়ে কঠিন কাজ শুরু হয় বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার পর।’

আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অনেক কঠিন ধাপই আমরা অতিক্রম করেছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক আমলের শাসনব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কাঠামো এবং নতুন মানুষ তৈরি করার সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কি আমরা সফল হয়েছি? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের এই বছরে এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন। একটি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা কর্তৃক পরিচালিত অর্থনৈতিক শোষণ আর রাজনৈতিক অন্যায় থেকে মুক্তিলাভের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। ধর্মীয় পরিচয়ের পরিবর্তে দেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

অথচ স্বাধীনতার চার বছর পরই বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল সামরিক শাসন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো পেয়েছিল রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরও দেখা গিয়েছে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য স্বৈরশাসন পরিচালনার জন্য দায়ী একজন সাবেক সেনা জেনারেলকে বিভিন্ন সময় গুরুত্ব দিয়েছে।

ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলকে তুষ্ট রাখারও চেষ্টা করেছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। একটি জোট সরকারে মন্ত্রী হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলের দুই নেতা। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় না। গত কয়েক দশকে সমাজে ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষদের ওপর হামলা হয়েছে এই বছরও। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি উদাসীনতা আছে। বন্ধ হয়নি ক্ষমতার কদর্য ব্যবহার আর রাজনৈতিক দুর্নীতি। একটি গণযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার পরও কেন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বিভিন্ন অন্যায় টিকে আছে আমাদের দেশে?

আর্জেন্টিনার দুই চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ফার্নান্দো সোলানাস আর অক্টাভিও গেটিনো তাঁদের এক বহুল পঠিত ম্যানিফেস্টোতে বলেছিলেন, ঔপনিবেশিকতা মোচনের জন্য ঔপনিবেশিক শক্তির আক্রমণের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করার পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসকের মানসিক বৈশিষ্ট্য নিজের মন থেকে নির্মূল করার জন্যও লড়াই করতে হয়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের অনেকেই কি পাকিস্তানি শাসকদের মানসিকতা থেকে নিজেদের মনকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন? প্রখ্যাত রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ফ্রানৎস ফানো মনে করতেন, অন্যায় শাসন থেকে কেবল স্বাধীনতা অর্জন করাই যথেষ্ট নয়, মনের মুক্তি নিশ্চিত করাও জরুরি। ফানো বলেছিলেন, মানুষের মনে যদি ঔপনিবেশিক কাঠামোবিরোধী নতুন বোধ জাগ্রত করা না যায়, তাহলে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি হয়ে ওঠে কেবল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা। মানুষের প্রকৃত মুক্তি এই পরিস্থিতিতে নিশ্চিত করা যায় না।

ফানোর মতে, তখনই প্রকৃত অর্থে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে, যখন স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হয়; আর নাগরিকদের মনে ভিন্ন চেতনা সংহত করার মাধ্যমে তাদের রূপান্তরিত করা হয় নতুন মানুষে।

শোষণমুক্ত, প্রগতিপন্থী একটি সমাজ তৈরির সচেতনতা নাগরিকদের মধ্যে তৈরি করতে হবে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে। এই দায়িত্ব পালন করা জরুরি, কারণ অন্ধ বিশ্বাস ও শোষণকে প্রত্যাখ্যান করার বোধ সৃষ্টির মাধ্যমেই কেবল একটি স্বাধীন দেশে নিশ্চিত করা যায় মানুষের প্রকৃত মুক্তি

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন শাসকদের আচরণের সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছিলেন, ‘তারা জানত না, কী করে একটা জাগ্রত জাতিকে দেশের কাজে ব্যবহার করতে হয় এবং জাতিকে গঠনমূলক কাজে লাগানো যায়। এরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শুরু করল ইংরেজ আমলের আমলাতন্ত্রের ওপর।’

স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণকে গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শাসকের নতুন মনোভাবের প্রয়োজনের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশেও ভিন্ন শাসন-কাঠামো এবং নতুন মানুষ গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। ঔপনিবেশিক শাসন-পরবর্তী সময়ে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে শিল্প এবং সংস্কৃতি সুচিন্তিতভাবে ব্যবহার করে নাগরিকদের চিন্তাশীল, সমাজসচেতন, আর যুক্তিবাদী করে তোলা জরুরি।

কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে সময় যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে বিনোদনধর্মী আর মুনাফামুখী সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রসার। দর্শককে বাস্তবতার প্রকৃত রূপ বোঝানোর পরিবর্তে হালকা বিনোদনে অভ্যস্ত করে তোলার এই চর্চা সম্পর্কে সরকার বা বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ চোখে পড়েনি বললেই চলে।

দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক নীতি, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণবিরোধী অবস্থান, বাঙালি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রভৃতি দিক যে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা নির্দেশ করে, এই বোধ মানুষের মনে তৈরি করার জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক সৃষ্টি কি সচেতনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে? চিন্তাঋদ্ধ সাংস্কৃতিক উপাদান নিয়মিত নির্মাণের চর্চা না থাকার জন্যই কি সমাজে অন্ধ আর অগভীর চিন্তার বিস্তার বাড়েনি?

ফানো আরও বলেছিলেন, রাজনৈতিক কাঠামোই রাজনৈতিক ব্যবহার নির্ধারণ করে। দেশে সেই কাঠামোই টিকে আছে যা নিশ্চিত করে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর বিশেষ সুবিধা। এই পরিস্থিতির প্রভাবের কারণে তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরাও ঔপনিবেশিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের পরিবর্তে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে ওঠার স্বপ্নই দেখতে থাকবে, এমন সম্ভাবনাই তৈরি হয়।

মানুষের মনে বৈপ্লবিক চেতনা সংহত করার কাজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখন আরও কঠিন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের সফল হতে হবে। শোষণমুক্ত, প্রগতিপন্থী একটি সমাজ তৈরির সচেতনতা নাগরিকদের মধ্যে তৈরি করতে হবে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে। এই দায়িত্ব পালন করা জরুরি, কারণ অন্ধ বিশ্বাস ও শোষণকে প্রত্যাখ্যান করার বোধ সৃষ্টির মাধ্যমেই কেবল একটি স্বাধীন দেশে নিশ্চিত করা যায় মানুষের প্রকৃত মুক্তি।

ড. নাদির জুনাইদ: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।