প্রথম আলোসহ বেশ কিছু খবরের কাগজে প্রধান খবর হয়েছে সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে। এর বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সাংসদদের মধ্যে। এ ক্ষোভের প্রকাশ করতে সংসদের বাজেট অধিবেশনে একজন প্রবীণ সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী এবং দলের নেতা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন করোনাসংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতি জেলায় একজন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ায়। তিনি বলেছেন, মানক্রমে সাংসদেরা সচিবদের ওপরে। বিষয়টি বিধি দ্বারা নির্ধারিত বলে কোনো বিতর্ক নেই। জানা গেল, এ ধরনের আমলানির্ভরতা নিয়ে তাঁর সমালোচনাকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কোনো কোনো সদস্য। এই নেতা আজ ছয় দশক দেশের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন। এখনো তিনি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তিনি জাতির জনকের রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। ১০ বছর ছিলেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁর বক্তব্যটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার দাবি রাখে।
করোনাসংক্রান্ত কার্যাবলি সমন্বয়ের জন্য প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে কমিটি রয়েছে। সে কাজ তদারকির জন্য একজন করে সচিব নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমারও কিছু সংশয় রয়েছে। কেননা, বিষয়টি আন্তমন্ত্রণালয়ভিত্তিক। সেখানে বিশেষ কোনো মন্ত্রণালয় তার আওতাধীন মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য বিষয়ে সরাসরি সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। তবে কোনো সমস্যা দ্রুত সমাধানে সহায়তা করতে পারবে। আর এ ধরনের তদারকি একজন মন্ত্রী কিংবা সাংসদের অধিকার বা মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে কি না, এটা ভেবে দেখার বিষয় রয়েছে। আরও ভাবার বিষয় রয়েছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হালকা হওয়ার বিষয়টি।
ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি থেকে থানার দারোগা, পিআইওসহ সব ক্ষেত্রেই ‘আমাদের লোক’ চান রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। এটা অনেকটা প্রথা হয়ে গেছে, ফলে মাঠ প্রশাসনে অনেকটা ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড।
এখানে আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা আমি একাধিক নিবন্ধে উল্লেখ করেছি। লিখেছি ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক ময়দানের মূল খেলোয়াড় হয়ে উঠছেন। সংসদে তাঁদের সংখ্যাধিক্য। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হওয়া দোষের কিছু নয় বরং সম্মানের। তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকায় রয়েছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও অনেকটা তাঁদের হাতে যাওয়ায় রাষ্ট্রের নীতি তাঁদের অনুকূলে থাকছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে প্রবল আয়বৈষম্য। বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে সূচনা থেকেই তাদের প্রাধান্য ছিল। বিপরীত অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ। তাদের নীতিতে প্রাধান্য পেত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। কিন্তু প্রধানত ২০০৯ সাল থেকে বিষয়টি বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। আর এভাবে রাজনীতিতে ধনিক-বণিকশ্রেণি প্রাধান্য সৃষ্টিতে সহায়তা করছেন রাজনীতিবিদেরা। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড মূলত রাজনীতিক নিয়েই গঠিত। তাই রাজনীতির মাঠের খেলোয়াড় পরিবর্তনের দায়ও তাঁদের নিতে হবে। তাঁরা নিজেদের অবস্থান ভিন্ন শ্রেণির কাছে কেন ব্যাপক পরিমাণে ছেড়ে দিচ্ছেন না, এটা বোধগম্য নয়। আর এ বিষয়টি হালের ক্ষোভের সঙ্গে সরাসরি প্রাসঙ্গিক না হলেও সংশ্লিষ্ট।
ঠিক তেমনি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রায়ণের পর থেকে সব রাজনৈতিক সরকার নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে বরাবর ‘আমাদের লোক’ তত্ত্ব বহাল করেছে। আর দিন দিন ভারী হচ্ছে তা। ‘আমাদের লোক’ হওয়ার সুফল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা টের পেয়ে গেছেন। তাই একটি অংশ নিজ থেকেই সরকারদলীয় লোকের মতো আচরণ করছে। তখনকার মতো প্রীত হচ্ছেন রাজনৈতিক প্রভুরা। মাঠ প্রশাসনের এ প্রবণতা শোচনীয় রকমের বেশি। ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি থেকে থানার দারোগা, পিআইওসহ সব ক্ষেত্রেই ‘আমাদের লোক’ চান রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ। এটা অনেকটা প্রথা হয়ে গেছে, ফলে মাঠ প্রশাসনে অনেকটা ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেকে এখন দলীয় লোকের মতো আচরণ করেন। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো অংশকে অবজ্ঞা করার অভিযোগও রয়েছে কারও কারও ক্ষেত্রে। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতারা এগুলো দেখে প্রতিবিধান করলে এমনটা হতো না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থাকবেন যেকোনো ধরনের সরকারব্যবস্থায়, আর এ উপমহাদেশে সে কর্মচারীদের নির্দলীয় থাকার ঐতিহ্য ছিল দীর্ঘকালের। সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেই কর্মচারীদেরই কেউ কেউ এখন মনিবের আসনে বসতে চাইছেন। জমিদার সতর্ক ও সচেতন না থাকলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নায়েবরা জমিদার হয়ে যেতেন। এটা অতি নিকটের ইতিহাস। অনেকেরই জানা।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থাকবেন যেকোনো ধরনের সরকারব্যবস্থায়, আর এ উপমহাদেশে সে কর্মচারীদের নির্দলীয় থাকার ঐতিহ্য ছিল দীর্ঘকালের। সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় যায়। আদালতের একটি আদেশ সম্বল করে তারা উঠিয়ে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এরপর দুই দফায় নির্বাচন গেল। নির্বাচনগুলোকে আইনগতভাবে অবৈধ বলছি না। তবে রাজনৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য, সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সর্বশেষ ২০১৮-এ নির্বাচনটিতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার গেছেন কজন? ভোট তো পড়েছে লাখ লাখ। সে ভোট কে বা কারা দিয়েছেন, কারা করেছে নিয়ন্ত্রণ—এটা আর অজানা বিষয় নয়। সাংসদেরা সংসদে বক্তব্য দিচ্ছেন। হয়তোবা আইনত তাঁরা নির্বাচিত সাংসদ। কিন্তু সে নির্বাচনগুলোর সঙ্গে জনগণের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু, তা তো সবাই জানেন। এর ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আনুগত্য কিছুটা শিথিল হয়েছে বলে ধরা যায়। এটা অভিপ্রেত না হলেও অনিবার্য।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কিন্তু চলমান ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিজেদের সব সময় দূরে রাখতে পারেন না। তাই দেখি ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসামির তালিকায় কয়েকজন পদস্থ পেশাদারি কর্মকর্তাকেও। স্বাধীনতাসংগ্রামেও ছিলেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের একটি অংশের উপস্থিতি ছিল ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের দ্বারা সংগঠিত জনতার মঞ্চে, যদিও বিষয়টির যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। এসব কারণেই সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আজ আগের অবস্থানে নেই।
তবে এই নিবন্ধকার আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন দেশ পরিচালিত হওয়া উচিত রাজনৈতিক কর্তৃত্বে। তবে সে কর্তৃত্ব প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত ক্ষমতায় বাধা দেওয়ার জন্য নয়। বরং এর প্রয়োগ যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা তদারকি ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনার জন্য ‘ওদের লোক’ বিবেচনায় যোগ্যতর ব্যক্তিকে বাদ দেওয়া হবে না পদোন্নতির তালিকা থেকে। আজ সেই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি আবশ্যকীয় শর্ত একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংসদদের মর্যাদা যেমনটা ওপরে আছে, আমরা চাই তেমনই থাকুক। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা হোন তাঁদের সহায়ক শক্তি।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com