‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী।’
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রায় ১৫০ বছর আগে মানুষের ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির পাশাপাশি হৃদয়–মনের ক্ষুধা নাশের জন্য একটু বাজে খরচের উপদেশ দিয়ে গেছেন। সে সময়ের আরেক সাহিত্যিক নাকি বিলেত থেকে কোটের বোতাম আনিয়ে পরিধেয় দৃষ্টিনন্দন করে গড়তেন। আর ঠাকুরবাড়ির শখ-শৌখিনতা নতুন করে উল্লেখ বাতুলতামাত্র। সাঁওতাল মেয়েটি কানে ক্যামেলিয়া গুঁজে—‘ডেকেছিস কেনে? আমি বললেম ‘এই জন্যেই’ বলে যে অসাধারণ কবিতাটি রবিঠাকুর শেষ করেছেন, সেখানেও কালো রূপকে আলোদান করতে একটি ফুলের শিল্পমহিমার জয়গান আছে। এই যে প্রয়োজনের বাইরে অপ্রয়োজনের জন্য মানুষের ছটফটানি, এরই অপর নাম কি ভোগবাদিতা?
একটু বয়সী পুরুষদের কেউ কেউ এখনো বলেন, ‘জীবন হবে সাদামাটা, চিন্তা হবে বড়’। যাঁরা এমন কথা এখন বলেন, তাঁরাও তারুণ্যে সেফার্স ঝরনা কলম ব্যবহার করেছেন, গিলে করা পাঞ্জাবি পরেছেন, কাশ্মীরি শাল গায়ে না জড়িয়ে ঘাড়ের ওপর আলতো করে ফেলে রেখেছেন, বিদেশ থেকে রোলেক্স ঘড়ি আনিয়েছেন। বয়সভেদে ভোগের তারতম্য ঘটে। যৌবনে ব্যক্তিসৌন্দর্য বাড়াতে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের যে বাহুল্য থাকে, পরিণত বয়সে তার ধরন পাল্টায়। তখন অভিজাত এলাকায় ভালো বাড়ি, দামি গাড়ি, ধনী বৈবাহিকী, বিদেশে সেকেন্ড হোম ইত্যাদির দিকে ধাবিত হতে থাকে। তাঁদের দিকে ভোগবাদিতার দিকে আঙুল তুললে তাঁরা আবার মনীষীদের বাণী উদ্ধৃত করে বলেন, ‘যে জীবনে কোনো অগ্রগতি নেই, সে জীবন অবাঞ্ছিত’।
এই অগ্রগতি ত্রিকালদর্শীদের কাছে মানসিক উত্তরণ বোঝালেও বাস্তবে বৈষয়িক উন্নতিরই নামান্তর।
চার্বাকপন্থীদের মতে ‘যাবৎ জীবেত সুখং জীবেত, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেত’। অর্থাৎ ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। এ তো দেখি ভোগবাদিতার চূড়ান্ত। এক অবিমৃশ্যকারী বাসনা। আবার অন্য পন্থীরা বিশেষ করে সন্ন্যাস গ্রহণকারীরা বলেন, ‘ত্যাগেই মুক্তি, ভোগে নয়’। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত সন্ন্যাসীদের মধ্যে কিছুদিন কাটাতে গিয়ে সেখানে দুধ আর ঘিয়ের মোচ্ছব দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। যত্নআত্তিতে তারও ‘কিছুটা ভুঁড়ির লক্ষণ দেখা দিয়াছিল’।
বলা হয়ে থাকে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সম্পদের সমবণ্টনসহ শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখেছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাদের ভোগবাদিতার আকাঙ্ক্ষা পুঁজিবাদী বিশ্বের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না বলে আজ সমাজতন্ত্রের নেকাবের নিচে পুঁজিতন্ত্রের ফল্গুধারা।
এই যে এত লম্বা লকডাউন, শখের কেনাকাটা নেই, ঘোরাঘুরি নেই, খাওয়াদাওয়া নেই, তাতে ভোগবাদী মানুষের যে খুব ক্ষতি হয়েছে, তা তো নয়। কিন্তু মানসিক স্ফূর্তি কি আছে? ওই এক কথা—‘আর কত দিন? আর ভাল্লাগে না!’ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য আনন্দও দরকার। পুরুষেরা ঘরের মধ্যে থেকে দাড়িগোঁফ ছেড়ে দিয়ে বুড়ো হচ্ছেন, নারীরা সাজসজ্জা বিমুখ হয়ে বিষণ্নতায় ভুগছেন, অল্প বয়সীরা বাইরে বেরোতে না পেরে বিরক্তির একশেষ। দেশের বাইরে ভ্রমণে গেলে আমরা কি কেবল দর্শনীয় স্থান বা ঈপ্সিত বস্তুই দেখে থাকি? কেনাকাটা করাও ভ্রমণেরই অংশ। কিন্তু যারা দেখার চেয়ে বেশি কেনাকাটাকে প্রাধান্য দেন, তাদের নির্দোষ ভোগবাদীর বেশি কিছু ভাবা যায় না।
সুকুমার প্রবৃত্তির প্রশ্রয় দিতে গেলে একটু বেহিসেবি না হলে চলে না। ব্যয়কুণ্ঠা যেমন নিন্দনীয়, অবিমৃশ্যকারিতার ফলও তেমনই ভয়াবহ। সবচেয়ে ভালো লোভের রাশ টেনে ধরা। এই মহামারি থেকে আমাদের এ শিক্ষা হলে ভালো যে আমরা অনেক বাহুল্য বর্জন করেও চলতে পারি। আমরা অপচয়ের আনন্দে মেতে না উঠলে প্রকৃতির ওপর চাপ কম পড়বে। নির্মল আনন্দের জন্য একটি ফুলই যথেষ্ট। একজন মানুষের খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, নিয়মানুবর্তিতা যেমন তার শারীরিক স্বাস্থ্যের ভালোমন্দের নিয়ামক, তেমনি জীবনযাপনে পরিমিতিবোধও পরিণামদর্শিতার পরিচায়ক। যেসব সন্তান অভিভাবকের কাছে কিছু চাওয়ার আগেই দ্বিগুণ পেয়ে অভ্যস্ত, তাদের ভবিষ্যৎ দুর্ভাবনামুক্ত নয়। কথায় আছে, শখের তোলা আশি টাকা। অনেক প্রতীক্ষার পর যে শখ মেটে তার আনন্দ অপার্থিব। শখ, আনন্দ থাকবে, কিন্তু তা যেন লোক দেখানো প্রতিযোগিতার বিষয় না হয়। কারণ, কথায় আছে, ‘অতিরিক্ত সবকিছুই বিষ’। অতি ভোগবাদিতার বিষের আক্রমণে আমরা এখন নাকমুখ ঢেকে দরজা–জানালা বন্ধ করে বসে আছি। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আর বলছি, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’
কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের ভাষায় বলতে ইচ্ছে হচ্ছে: ‘এহন তুমি কাঁদতিছ? তুমি এহন কাঁদতিছ?’
উম্মে মুসলিমা: লেখক
muslima.umme@gmail.com