ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন

আমাদের বর্ণবাদী মন

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বিলাতফেরত ব্যারিস্টার ছিলেন। কিন্তু ভারতে আইন ব্যবসা জমাতে না পেরে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সে দেশে থাকার সময় তিনি আইন ব্যবসার পাশাপাশি ভারতীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর চেষ্টা ছিল এটা প্রমাণ করা যে ভারতীয়দের গায়ের রং কালো হলেও তারা আফ্রিকানদের চেয়ে শ্রেয়তর, ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গদের সমগোত্রীয়।

গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পরপরই সে দেশের আইন পরিষদে এক চিঠি লিখে ভারতীয়দের শ্বেতাঙ্গ হিসেবে মর্যাদার দাবি তোলেন। তিনি যুক্তি দেন, ভারতীয় ও শ্বেতাঙ্গরা উভয়েই নৃতাত্ত্বিকভাবে ‘আর্য গোত্রীয়’। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পরপরই গান্ধী সে দেশের শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের বর্ণবাদী মনোভাবের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৮৯৩ সালে এক মামলার সূত্রে তিনি নাটাল থেকে ট্রেনে করে প্রিটোরিয়া যাচ্ছিলেন। সঙ্গে প্রথম শ্রেণির টিকিট, যথারীতি নিজের আসনে এসে বসলেন। খানিক পর একই কামরায় এলেন এক সাদা সাহেব, গান্ধীকে দেখে তো তিনি রেগে কাই। প্রথম শ্রেণিতে শুধু সাদাদের থাকার কথা, ‘কুলিদের’ নয়। তঁার অভিযোগের পর ট্রেনের চেকার এসে গান্ধীকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ভিন্ন কামরায় সরে যেতে বললেন। গান্ধী বললেন, না যাব না, আমার প্রথম শ্রেণির টিকিট আছে। চেকার এবার ডেকে আনলেন একজন সাদা পুলিশকে। সে কোনো কথায় কান না দিয়ে একটানে গান্ধীর স্যুটকেস ছুড়ে ফেলে দিল ট্রেনের প্ল্যাটফর্মের ওপর।

এ অভিজ্ঞতার পরও কালোমাত্রই যে বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার, বিষয়টি গান্ধীর মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। তাঁর একমাত্র নজর ছিল ভারতীয়দের ও কালো নিগারদের এক পাল্লায় বিচারের ‘বৈষম্যমূলক’ ব্যবস্থার প্রতিবাদ। অধ্যাপকদ্বয় লিখেছেন, বর্ণবাদী ব্যবস্থার অধীনে ডারবানের পোস্ট অফিসে সাদা ও কালোদের ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশপথ নির্ধারিত ছিল। কালোদের সঙ্গে ভারতীয়দের এক দরজা দিয়ে ঢুকতে হতো। গান্ধী তার প্রতিবাদ করে বললেন, আমাদের (অর্থাৎ ভারতীয়দের) স্থানীয় ‘নেটিভদের’ গোত্রে ফেলা হয়েছে। ভারী অন্যায়। আমাদের জন্য ভিন্ন প্রবেশপথ চাই।

গভীর বর্ণবাদী এই গান্ধীর স্বরূপটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সূত্রে। ওয়াশিংটন ডিসিতে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে একটি গান্ধীমূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘানার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধীমূর্তি তুলে নেওয়া হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে আমস্টারডামে ও ব্রিস্টলে। গান্ধীর প্রপৌত্র তুষার গান্ধী বলেছেন, ঠিকই হয়েছে। গান্ধী বেঁচে থাকলে নিজেই নিজের মূর্তি সরানোর সিদ্ধান্ত সমর্থন করতেন।

এ কথা ঠিক যে গান্ধী পরবর্তী সময়ে নিজের অবস্থা বদল করেন। তিনি মহাত্মা হয়ে ওঠেন, দলিতদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত হন। তবে তাঁর এ পরিবর্তন কতটা রাজনৈতিক আর কতটা গুণগত, তা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। বস্তুত শুধু গান্ধী কেন, চরিত্রগতভাবে অধিকাংশ ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয় মানুষের কাছে কালো মাত্রই ব্রাত্য। অধিকারভোগী শ্রেণির মানুষ হিসেবে গান্ধী তাঁর সমগোত্রীয়দের মতো কালোদের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মনোভাব পোষণ করবেন, এতে অবাক কী! শৈশব থেকেই তো আমাদের সবার কালো গাত্রবর্ণের প্রতি বিরূপ মনোভাব। গায়ের রং সাদা করার জন্য আমাদের দেশের মানুষদের কী প্রাণান্ত চেষ্টা। শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও তাই ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’র ব্যবস্থা হয়েছে।

কালোদের প্রতি আমাদের প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা বা ঘৃণার উৎস সমাজের শ্রেণিগত বিভক্তি। আমাদের রাজারা, ইংল্যান্ড থেকে আসাই হোক আর বাগদাদ থেকে—বরাবরই ছিল ফরসা, লম্বা, সুঠাম। আমাদের মাথায় সুন্দর ও ক্ষমতাবান মানেই এসব বিদেশি ফরসা মানুষের ছবি। হলিউড, বলিউড থেকে সে ছবিটাই আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কালো মানে ময়লা। অর্থাৎ অশুচি। কালো মেয়ের দুঃখ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কবিতা লিখতে হয়েছে। সেই রবীন্দ্রনাথকে আমরা সর্বদা গৌরবর্ণের বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসি, যদিও প্রকৃত গৌরবর্ণের মানুষের চোখে তিনি কালোই ছিলেন। শুধু আমাদের নয়, আমেরিকার কালোদের মধ্যেও সুন্দর মানে ভাবা হতো সাদা। এখনো আমেরিকায় কালো শিশুরা সাদা ও সোনালি চুলের বারবি ডল নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল,’ স্লোগান তো এই সেদিনের।

স্বদেশে হোক বা প্রবাসে, বর্ণগতভাবে আমরা উপমহাদেশের সবাই কালো মানুষ, অথচ কেউ নিজেদের কালো ভাবতে প্রস্তুত নই। আফ্রিকান-আমেরিকানদের আমরা নিগার বলি না ঠিকই, কিন্তু বলি ‘কালুয়া’। সেটা কদর্থেই বলা। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে দক্ষিণ
আফ্রিকা থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের দর্শকদের বর্ণবাদী বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ভারতের আইপিএলে খেলতে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদেরও একই রকম বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ক্যাপ্টেন ড্যারেন স্যামি বলেছেন, তাঁকে ড্রেসিংরুমে সবাই ‘কালু’ বলে ডাকত, তাঁর ধারণা ছিল কালু মানে শক্তিশালী ঘোড়া। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে খেলতে গিয়ে পাকিস্তানি খেলোয়াড় সরফরাজ আহমদ এক কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়কে ‘আবে কালুয়া’ নামে সম্বোধন করেছিলেন। কালোর প্রতি এ ঘৃণা আমাদের রক্তে।

কালো হয়তো গায়ের রং, কিন্তু কালো বলতে আসলে আমরা বোঝাই দরিদ্রকে। নিজেরা দরিদ্র হলেও দরিদ্রের প্রতি অনেক সময়েই আমাদের সহানুভূতি নেই। নিউইয়র্কে আমি একটি টক শো সঞ্চালনায় যুক্ত ছিলাম। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করেন, এ কথা বলায় শো চলাকালে এক দর্শক ফোন করে তিরস্কার করে বলেন, প্রেসিডেন্ট তো ভুল কিছু করেননি। কালোরা নোংরা, অপরাধী, মাদক বিক্রেতা। তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন কেন?

প্রবাসে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, আমরা বাঙালিরা দৈনন্দিন বৈষম্যের সম্মুখীন হলেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ নেই। এর পেছনে শৈশব থেকে গড়ে ওঠে কালোবিদ্বেষ একটি কারণ। অন্য কারণ বিদেশে সফল হতে হবে, এ মনোভাব নিয়ে আমরা সব বিদ্রূপ সয়ে চলি, মুখ কামড়ে পড়ে থাকি। অধিকাংশ ব্যাপারেই আমরা শ্বেতাঙ্গদের পক্ষে, সে জন্য এ দেশে আমাদের ‘মডেল মাইনরিটি’ হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, সম্ভবত এ ভয় থেকেই এ দেশে নাগরিক অধিকারের পক্ষে যে আন্দোলন, তার কোনোটাতেই আমরা নেই। বর্তমানে আমেরিকাজুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন চলছে, তাতে সবাই আছে, দক্ষিণ এশীয়রা কেন নেই, এমন প্রশ্ন তুলেছে সিএনএন। সাদাদের নীরবতা যদি সহিংসতার সমার্থক হয়, তাহলে দক্ষিণ এশীয়দের নীরবতাও কার্যত বর্ণবাদের সমর্থনে সহিংসতা, এমন কথাও বলা হচ্ছে।

আশার কথা, এ অবস্থা বদলানো শুরু করেছে। নবীন প্রজন্মের সদস্যরা খোলামেলাভাবেই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছে। তারা এখন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে পিওসি বা পিপল অব কালার এই নামে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, কানাডা ও যুক্তরাজ্যেও দেখছি কালো ও বাদামি মানুষদের হাতে হাত ধরে চলা। সংখ্যায় হয়তো কম, কিন্তু তারাও ক্রমে পথে নামছে।

এ আন্দোলনের ভেতর দিয়েই প্রবাসে হয়তো কালোর প্রতি আমাদের মনোভাব বদলাবে, কিন্তু উপমহাদেশে আমাদের মনের ভেতর যে বর্ণবাদ আসন গেড়ে বসে আছে, তা বদলাবে কীভাবে? আমেরিকায় দাস আফ্রিকানরা দীর্ঘকাল শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় নিজেদের নিকৃষ্ট ভেবেছে। তারাও শ্বেতাঙ্গ দাসপ্রভুর মতো হতে চেয়েছে। মনের গভীরের এ উপনিবেশ তা ভাঙতে সময় লেগেছে। এ জন্য কালো মানুষকে অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়েছে। ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ বা ‘কালো সুন্দর’—এ কথা প্রতিষ্ঠা করতে তাদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভেতর দিতে এগোতে হয়েছে। আজকের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সেই আন্দোলনেরই সম্প্রসারণ। আমাদের মনের মধ্যে যে বর্ণবাদী উপনিবেশ, তা হটাতে হলেও চাই ঠিক সেই রকম এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক