বাংলাদেশের উন্নয়ন জগতের পথপ্রদর্শক, যিনি বটবৃক্ষের মতো একজন অভিভাবকও হয়ে উঠেছিলেন, তিনি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, আমাদের সবার প্রিয় আবেদ ভাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি সিলেটের প্রত্যন্ত শাল্লা গ্রামে, নিজের ধ্যানধারণা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। ক্রমে ক্রমে সেই কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটেছে। এসেছে ব্যাপকতা, আবির্ভূত হয় বিশাল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি ক্রমে দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থিক ক্ষমতায়ন, মানবসক্ষমতা ও মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সব উপাদান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার ও আর্থিক উন্নয়নে বহুমাত্রিকতা নিয়ে এসেছেন। অতঃপর ব্র্যাকের পদযাত্রা এনজিও করপোরেটের অবয়ব পেল এবং আবেদ ভাই নিরলসভাবে উন্নয়নজগতে আলোর দিশারি হয়ে এগিয়ে চললেন। তিনি এনজিওগুলোকে দেখালেন এবং উদ্বুদ্ধ করলেন সরকারের পাশাপাশি দেশব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নতি সাধনের। এখানেই শেষ নয়, তিনি বাংলাদেশের বাইরেও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন আড়ং, পোলট্রি, ডেইরি, সিড ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন।
প্রথম দিকে অনেক সমালোচিত হয়েছেন। কেন উন্নয়ন সংস্থা ব্যবসা করবে? কেন ব্র্যাক উপকারভোগীকে ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি বিভিন্ন শাকসবজির বীজ কিনতে বাধ্য করবে? তিনি গরিব মানুষের পুষ্টির কথা ভেবেই এটা করেছিলেন। ব্র্যাকের দেখাদেখি অনেক এনজিও সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। কিন্তু সবাই সফল হতে পারেনি। তার কারণ যেটি আবেদ ভাই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, সেটা অন্যরা করতে পারেননি। তিনি এটা বুঝেছিলেন যে একটি সংগঠনকে টেকসইভাবে এগিয়ে নিতে হলে দিকনির্দেশনার জন্য উপযুক্ত পর্ষদ, সংগঠন পরিচালনার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাদারি প্রয়োজনীয় জনবল, হিসাববিদ, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।
আমি ব্র্যাকে আমার কর্মজীবন শুরু করি ১৯৯১ সালের জুন মাসে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলাম। ব্র্যাকে দরখাস্ত জমা দিই, যথারীতি ইন্টারভিউর জন্য যাই এবং আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সদা পরিপাটি লোকটিকে দেখে শ্রদ্ধাবোধ হলো। আমি সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগপত্র পেলাম। আবেদ ভাই অবশ্য আমাকে আমার ফল বের হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, কারণ সিএ প্রফেশনাল হিসেবে আমি আরও উচ্চ পদ পেতে পারি। তিনি আমাকে বলেন, ব্র্যাকের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষানবিশকালে পাস করলেও আমার পদ পরিবর্তন হবে না। কিন্তু সেই সময়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব মানসিক চাপে ছিলাম। ভরসা করতে পারছিলাম না পাস করতে পারব কি না। তাই যোগ দিয়ে দিলাম। ব্র্যাকে কর্মরত থাকাকালে ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পাস করলাম।
শুধু চার মাসের মতো কাজ করার পর আমি কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করার কথা ভাবি। ব্র্যাক ছাড়ার কথা যখন বললাম এবং আমার সিদ্ধান্তের কারণও জানালাম। তিনি স্বভাবসুলভ স্মিত হাস্যে খুব ইতিবাচকভাবে অনেক সময় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করলেন এবং বললেন, তাঁর আমাকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা ছিল। তাঁর সঙ্গে সেই আলাপচারিতা আমার জন্য অনেক শিক্ষণীয় ছিল। জানলাম তিনি তাঁর অধীন সহকর্মীদের কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তাঁদের নিয়ে তাঁর একেকটি পরিকল্পনা আমাকে অভিভূত করে। সেই সময়ে, কাছে থেকে দেখেছি আবেদ ভাই কীভাবে অসহায় বিপদগ্রস্ত, কোনো কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এমনকি বিধবা, ডিভোর্সি, সিঙ্গেল নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে জীবনের হাল ধরতে সাহায্য করেছেন। তাঁদের তিনি সুযোগ দিয়েছেন সম্ভাব্য গুণাবলি বিকাশে এবং পেশাগত জীবনে উন্নতি সাধনের এবং শীর্ষ পদে কেউ কেউ সফলতার সঙ্গে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। পরবর্তী সময়েও দেখেছি কোনো ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান যখন বিপদে পড়েছে, তিনি সাহায্যের হাত বাড়াতে কার্পণ্য করেননি। মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্যও তিনি সাহায্য করেছেন।
২০০১ সালে আমি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) যোগ দিই। তখন ব্র্যাক পিকেএসএফের অংশী সংগঠন ছিল। সেই সুবাদে আবার আবেদ ভাইকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই সময় ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পিকেএসএফ থেকে চেক নিতে তিনি নিজেই আসতেন। ২০১১ সালে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের সূচনার সময় আমাকে ব্র্যাক অ্যাসোসিয়েশন ও ইন্টারন্যাশনালের পর্ষদ সদস্য করেন এবং আমাকে ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালে ফিন্যান্স অ্যান্ড অডিট কমিটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেন। আবেদ ভাই সব সময় সব বিষয় ভালো করে দেখতে বলতেন এবং বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করতেন।
২০১৯ সালের জুন মাসে আমরা নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে মিটিংয়ের জন্য যাই। মিটিংয়ের মধ্যাহ্ন বিরতিতে আবেদ ভাই আমাকে বলেন, তিনি চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং পরবর্তী লিডারশিপ নিয়ে ভাবছেন এবং আমাদের সহযোগিতা চাইলেন। আমি অবাক হয়ে তাকালাম এবং শ্রদ্ধায় মন ভরে গেল। বাংলাদেশে এনজিও করপোরেটের ধারণা এবং প্রতিষ্ঠা হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। এবং বাংলাদেশে এখনো অনেকে তাঁর ধারণাকে অনুসরণ করে কাজ করে যাচ্ছেন। জুলাই ২০১৯ সালে ব্র্যাকের নির্ধারিত সময়ের মিটিং পিছিয়ে আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হলো। সেই সময় জানলাম তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিন্তু তাঁকে দেখলাম খুবই শান্তভাবে মিটিংয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে আবেদ ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। প্রতিনিয়ত তাঁর খবর নিয়েছি, কিন্তু দেখা হয়নি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নতুন নেতৃত্বের অধীনে ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হলো, আবেদ ভাই ছাড়া যে মিটিং কখনোই কল্পনা করা হয়নি। মিটিংয়ের পর তাঁর ছেলে শামেরান আবেদ জানান, আবেদ ভাইকে তিনি আগের দিন বলেছিলেন আগামীকাল মিটিং হবে। উনি তখন আস্তে আস্তে, ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘মেক শিয়োর, ইট রানস অন টাইম’। শুনেছি তিনি মুমূর্ষু অবস্থায়ও বারবার বলছিলেন অনেক কাজ বাকি, বাচ্চাদের স্কুল লাগবে, শিক্ষা দিতে হবে, নারীর সমতা লাগবে ইত্যাদি। আমরা আবেদ ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করি।
পারভীন মাহমুদ: দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের বোর্ড মেম্বার