কৃষিবিজ্ঞানী

আমাদের কৃষি গবেষণার পথিকৃৎ

কাজী এম বদরুদ্দোজা
কাজী এম বদরুদ্দোজা

১৯৭৪ সালের কথা। ফার্মগেটের খামারবাড়িতে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের সব বন্দোবস্ত চূড়ান্ত। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও খামারের ওই জমিতে হোটেল নির্মাণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়ে গেছে। এই খবর পেয়ে কাজী এম বদরুদ্দোজা ছুটে গেলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। গিয়ে বললেন, কৃষি গবেষণার জমিতে তিনি হোটেল বানাতে দেবেন না। বঙ্গবন্ধু বললেন, কেন? উত্তরে কাজী বদরুদ্দোজা বললেন, ‘এটা হলে কৃষির মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এই জমিতে হতে হবে কৃষি গবেষণার জন্য প্রশাসনিক সমন্বয়ের প্রধান কার্যালয়।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুই ঠিক কী চাস,আমার কাছে লিখে নিয়ে আয়।’ বঙ্গবন্ধুর সহকারীর কক্ষে গিয়ে কাজী বদরুদ্দোজা বাংলাদেশ ‘কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’ (বার্ক)–এর গঠনকাঠামো ও কার্যপরিধি এবং প্রস্তাব লিখে নিয়ে এলেন। বঙ্গবন্ধু তাতেই স্বাক্ষর করে অনুমোদন দিয়ে দিলেন। জন্ম নিল বাংলাদেশের কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী এই প্রতিষ্ঠান।

শুধু বার্ক নয়, স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কৃষি খাতের যতগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় সব কাজী বদরুদ্দোজার হাত দিয়ে তৈরি। শুধু ধান বা ভাত খেলে হবে না। সবজি, ফল ও আলুর মতো পুষ্টিকর খাবারও লাগবে। সঙ্গে থাকতে হবে মাছ, দুধ ও মাংস। এসব খাদ্য গৃহস্থপর্যায়ে স্বল্প পরিসরে উৎপাদিত হতো। কিন্তু বড় পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে চাষ ও উৎপাদিত হতো না। মাছ, গরু, মুরগি, ফল ও সবজির উন্নত জাত চাই। কিন্তু এগুলো কোথা থেকে আসবে? এসব চিন্তা করে কাজী বদরুদ্দোজার নেতৃত্বে একের পর এক দেশে প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব সংস্থার জন্য বিশাল পরিসরের কার্যালয়, ল্যাবরেটরি, স্থানীয় পর্যায়ে উপকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে আধুনিক সরঞ্জামাদি ও গবেষক তৈরির কাজেও তিনি নেতৃত্ব দেন। দেশের দুগ্ধ খামারিদের সংগঠন মিল্ক ভিটার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন, কে এই কাজী এম বদরুদ্দোজা? একজন ব্যক্তির কী এমন ক্ষমতা যে এত কিছু তিনি একাই করে ফেললেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ১৯২৭ সালে বগুড়ায় জন্ম নেওয়া এই কৃষিবিজ্ঞানীর অতীতের দিকে একটু তাকাতে হবে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা বগুড়ায় এসেছিলেন ভারতের মিরাট থেকে, সেখানকার নবাবদের বংশধর ছিলেন তাঁরা। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম সিপাহি বিদ্রোহে এই পরিবারের সদস্যরা যুক্ত ছিলেন। এতে ইংরেজ শাসকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে নিজেদের জীবন বাঁচাতে ভারত থেকে পালিয়ে এ দেশের মাটিতে আশ্রয় নেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়া ওই পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজী ছোটবেলা থেকেই মেধাবৃত্তির টাকা এবং টিউশনি করে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৪৫ সালে এসে ভর্তি হলেন উপমহাদেশের প্রথম কৃষি কলেজ তেজগাঁওয়ের বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে।

দেশের কৃষি গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার এই জীবন্ত কিংবদন্তি সম্পর্কে জানতে কথা হয় বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি তাঁর মূল্যায়নে বলেন, কাজী বদরুদ্দোজা একই সঙ্গে একজন বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান গবেষণার ব্যবস্থাপক এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কারিগর। আর গবেষণাকে মাঠপর্যায়ে নিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রেও তিনি একজন ভালো সংগঠক।

১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি-অ্যাগ্রি ডিগ্রি শেষ করার আগে কাজী ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে বিভাগীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনুমোদনে অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে একজন রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে সঠিকভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন ও নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য তিনি ‘ফুলব্রাইট’ স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রপ বোটানিতে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ দেশে ফিরে এসে কৃষি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। এরপর থেকে সারা জীবন তিনি নিজের গবেষণা এবং এ দেশের কৃষির উন্নতির জন্যই ব্যয় করে গেছেন।

১৯৫৭ সালে ড. বদরুদ্দোজা ইকোনমিক বোটানিস্ট (ফাইবার) পদ লাভ করেন। সেই সময়ের কৃষকদের কাছে ফসল বলতে ছিল প্রধানত ধান ও পাট। স্বল্প পরিচিত ফসল গম ও ভুট্টা চাষ সম্পর্কে জানার জন্য তিনি সুইডেনের বিশ্বখ্যাত স্তালভ গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এর পরপরই লুগন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ ইন জেনেটিকস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে দেশে ফেরেন এবং নতুন উদ্যমে কৃষি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক, নির্বাহী পরিচালক ও মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে উচ্চ ফলনশীল গম প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেন।

ধানের বাইরে বাংলাদেশের প্রধান দুটি দানাদার ফসল চাষ শুরুর ক্ষেত্রেও কাজী বদরুদ্দোজা নেতৃত্ব দেন। দেশে আধুনিক জাতের গম উদ্ভাবন ও চাষ শুরু করা আর ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদ তাঁর হাত দিয়ে শুরু। ভুট্টা থেকে তেল উদ্ভাবন এবং তা পোলট্রিশিল্পের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরুর ধারণাটিও তাঁর কাছ থেকে আসা। এসব অবদানের জন্য ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পান এই বিজ্ঞানী।

৯২ বছর বয়সেও এই বিজ্ঞানী কৃষিবিজ্ঞানীদের সংগঠন বাংলাদেশ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচারের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখনো তাঁর বাসায় প্রায় প্রতিদিন দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের আড্ডা বসে। বাংলাদেশের কৃষির ওই বটবৃক্ষের ছায়ায় সবাই আশ্রয় খোঁজেন। কেউ কোথাও আটকে গেলে কাজী বদরুদ্দোজার পরামর্শই শেষ ভরসা।

আজ চার প্রজাতির ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। ধানে তৃতীয়, সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে তৃতীয়, প্রাকৃতিক উৎসের মাছে তৃতীয়, গরু–ছাগলে দ্বিতীয় হওয়ার পেছনে যাঁদের ভূমিকা আছে, তাঁদের সবার আগে কাজী এম বদরুদ্দোজার নাম থাকবে।

ইফতেখার মাহমুদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

আরও পড়ুন:
তীর–প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার আজ