আজ থেকে ১৫ বছর পর খুব সম্ভবত দেশে অনেক সংক্রামক রোগীর শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না। হয়তো-বা হঠাৎ বেড়ে যাবে টাইফয়েড বা নিউমোনিয়ার মতো রোগের সংক্রমণ। চারদিকে হাহাকার কিন্তু চিকিৎসার জন্য কোনো প্রতিষেধক নেই। গল্প-উপন্যাসে এ রকম দেখলেও এটাই এখন বাস্তবতা। ‘প্লস ওয়ান’ গবেষণা নিবন্ধে প্রকাশিত বাংলাদেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জনে ৯ শিশুর মধ্যে সব কটি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। চট্টগ্রামে মোট ৭ শতাংশ রোগীর শরীরে দেখা গেছে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, অর্থাৎ সুপারবাগ তৈরি হয়েছে। প্রতি চারজন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে তিনজনের শরীরেই মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তথা তিনটি বা তার অধিক অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর দেখা গেছে। রোগীদের ৭০ ভাগের মধ্যেই দেখা গেছে অন্তত একটি অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি আরেকটি মহামারির দিকে।
পৃথিবীজুড়ে পালিত হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা সচেতনতা সপ্তাহ। ‘সচেতনতা বাড়াও, অকার্যকারিতা কমাও’ প্রতিপাদ্যে পালিত হচ্ছে এই সপ্তাহ। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা পুরো বিশ্বেই এই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীবের সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক যেমন একটি চমৎকার প্রতিষেধক, ঠিক তেমনি আমাদের অসচেতনতার কারণে এই অ্যান্টিবায়োটিক যখন তার কার্যকারিতা হারাবে, তখন তা আমাদেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, বিকল্প আর কোনো চিকিৎসার পথ খোলা নেই।
দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা দেখা গেছে নবজাতক, শিশু ও তরুণদের মধ্যে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতা বর্তমান বিশ্বে একটি ভয়ংকর স্বাস্থ্য সমস্যা। ব্যাকটেরিয়া তথা অণুজীবের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যত কমে যাবে, তত বেশি এসব জীবাণুর সংক্রমণ বেড়ে যাবে, এর চিকিৎসার উপায় বা প্রতিষেধক কমে যাবে ও সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করবে। আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বিপুলসংখ্যক রোগী অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে। হাসপাতালের বেসিন থেকে পানি, নালার পানি, বিছানার চাদর, দেয়ালের বিভিন্ন নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী এমন একাধিক জিন চিহ্নিত করা হয় একাধিক গবেষণায়।
কেন এমন হচ্ছে?
প্রথমত, অ্যান্টিবায়োটিক এর অতিরিক্ত কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার শরীরে অণুজীবগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা তৈরি করে এবং পরবর্তীকালে এই অ্যান্টিবায়োটিক ওই ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারায়। ফলে ওই রোগে আক্রান্তদের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর কোনো প্রতিষেধক বা চিকিৎসার উপায় থাকে না। এ ছাড়া একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা তীব্র সংক্রমণের দিকে রোগীকে ধাবিত করে। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের অণুজীব মা থেকে শিশুতে প্রবাহিত হতে পারে। গর্ভবতী হওয়ার সময়ে বা আগে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ এ অকার্যকারিতার কারণ হতে পারে। তৃতীয়ত, পোলট্রি ও গবাদিপশুকে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের কারণে পরবর্তী সময়ে দুধ, মাংস কিংবা এ রকম বিভিন্ন উৎস থেকে মানবদেহে প্রবাহিত হতে পারে এ রকম অণুজীব বা অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতার জন্য দায়ী জিন। চতুর্থত, অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এই অকার্যকারিতা সৃষ্টি করছে। পঞ্চমত, হাসপাতাল থেকে বিভিন্নভাবে রোগীদের দেহে এসব অণুজীব রোগীদের দেহে প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো আমরা খুব অল্প সময়েই রোগ থেকে মুক্তি চাই। যখন-তখন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলি, এমনকি বাচ্চাদেরও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই। অকারণে বা অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
কোন কোন এলাকায় বেশি মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স রোগী? বিভিন্ন গবেষণায় ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ম্যাপিং’ তথা অ্যান্টিবায়োটিক কোন কোন অংশে বেশি, তা চিহ্নিত করা হয়। শহর এবং গ্রাম উভয় জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে এই অকার্যকারিতা। তবে শহর অঞ্চলে এই অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকারিতার হার অনেক বেশি। এর পেছনে শহরে ফার্মেসির সংখ্যাধিক্য অন্যতম কারণ।
কী করা দরকার?
ভবিষ্যতে সব কটি হাসপাতাল এবং দেশব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা ও এর বিভিন্ন প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ও অননুমোদিত বিক্রির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়নি। দেশে এই মুহূর্তে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার ফার্মেসি রয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকই সরকারি লাইসেন্সবিহীন। এগুলো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক কখন, কেন, কীভাবে, কার পরামর্শে খেতে হবে, তা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নীতিমালা প্রয়োজন। আমাদেরও বুঝতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিক কোনো চকলেট বা বিস্কুট নয়। যখন ইচ্ছে খাওয়া যাবে না। একটা ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্যসমস্যাকে বয়ে বেড়াবেন, নাকি চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাবেন, সিদ্ধান্তটা আপনার।
আদনান মান্নান গবেষক ও শিক্ষক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। adnan.mannan@cu.ac.bd