মনে করুন, মাছ ধরা জেলেদের শান্ত দ্বীপ হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মহা কেন্দ্রস্থল, শান্ত সৌম্য নদীতীরে গড়ে উঠেছে বিরাট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দরের কয়লা টার্মিনালে বহু দূরবর্তী দেশ থেকে আনা টনের পর টন কয়লা নামছে স্তূপ আকারে আর এলএনজি বহনকারী বড় বড় জাহাজ এলএনজি টার্মিনালে এসে তরল জ্বালানি আবার গ্যাসে রূপান্তর করে জাতীয় গ্যাস পাইপলাইন গ্রিডে সঞ্চালন করছে। এটি নেহাত কল্পনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সম্ভাব্য পরিবর্তিত দৃশ্যপট।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অতীতের মূলত একক জ্বালানিনির্ভর (গ্যাস) সীমিত পরিসর ছাড়িয়ে বহুবিধ জ্বালানিনির্ভর ব্যাপক আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। আর এই বহুবিধ জ্বালানির মধ্যে অল্প অংশ নিজস্ব গ্যাস ছাড়া বাকি সবই আমদানীকৃত, যার মধ্যে থাকবে কয়লা, এলএনজি, তেল, আন্তদেশীয় বিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ইত্যাদি। সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২০২০ সালে ২১ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালে ৩২ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪০ সালে ৫৪ হাজার মেগাওয়াট করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ হচ্ছে (পিএসএমপি ২০১৬)। এ পরিবর্তন বিশাল, ব্যাপক ও দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে বলে দাবি করা হচ্ছে। আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর প্রায় সর্বতোভাবে নির্ভরশীল হওয়ার বিষয়টি অবশ্য অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। ২০১০ সালে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব গ্যাসের ওপর নির্ভরতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, সেখানে এক হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হবে ৯০ শতাংশের বেশি। আর দেশের অর্থনীতির ওপর এর ভার কতটা সহনীয় হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একটি বিষয় লক্ষ করা যায়, আগামী দিনের জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় সরকার প্রায় পুরোপুরিভাবে আমদানিনির্ভর হওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। আমদানীকৃত জ্বালানি আসবে অর্থমূল্যের বিনিময়ে। দেশীয় নিজস্ব জ্বালানিনির্ভর ব্যবস্থাপনা থেকে মূলত আমদানীকৃত জ্বালানিনির্ভর ব্যবস্থাপনায় গেলে তা দেশের অর্থনীতির ওপর বড় আকারের চাপ দেবে। এক হিসাব অনুযায়ী, আগামী বছরের শেষ নাগাদ দেশে প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এলএনজি আমদানির মাধ্যমে আনা হবে, যার জন্য প্রতিবছর খরচ পড়বে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা (পদ্মা সেতু নির্মাণ খরচ ২৫ হাজার কোটি টাকা)। আর এলএনজি আমদানির পরিমাণ পরবর্তী বছরগুলোতে বাড়িয়ে প্রতিদিন ২০০ কোটি, তারপর ৩০০ কোটি থেকে ক্রমান্বয়ে ৪০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এদিকে বিরাট আকারের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও আমদানীকৃত কয়লা ব্যবহার করে চালানো হবে। উচ্চমূল্যের এলএনজি ও কয়লার ব্যবহার উৎপাদিত বিদ্যুৎ ও শিল্পজাত দ্রব্যের দাম নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেবে।
প্রশ্ন উঠেছে, এ ব্যবস্থাপনা কি টেকসই হবে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ ও দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে? উদ্বেগের বিষয়, এক ঘনফুট এলএনজি দেশের মাটিতে পৌঁছানোর আগেই কেবল তার আগমনী বার্তা শুনিয়ে গত বছর থেকে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই প্রশ্ন, উপরিউক্ত ব্যবস্থাপনা সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বর্তমান তীব্র গ্যাস-সংকটের প্রেক্ষাপটে কেবল স্বল্প মেয়াদে সীমিত এলএনজি আমদানি করা যুক্তিসংগত হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বৃহৎ আকারে উচ্চমূল্যের এলএনজির ওপর নির্ভর করা যুক্তিসংগত হবে না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের কিছুটা মূল্য বৃদ্ধি এই ইঙ্গিত দেয় যে তেল এবং সেই সঙ্গে এলএনজির বর্তমান অপেক্ষাকৃত নিম্নমূল্য দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
এদিকে দেশের ভূবিজ্ঞানীবা এই মত পোষণ করেন যে উপরিউক্ত ব্যবস্থাপনার বিকল্প বিদ্যমান এবং তা হলো দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া। তাঁদের মতে, অধুনা বাংলাদেশে গ্যাস নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার স্লোগানটি অতিরিক্তভাবে উচ্চারিত হতে দেখা যায়, আর সে তুলনায় নতুন গ্যাস সম্পদ আবিষ্কারের সম্ভাবনাটি অত্যন্ত নিম্নস্বরে উচ্চারিত হয়। অথচ যেকোনো মানদণ্ডে বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান কর্মকাণ্ডের ধারা অতি দুর্বল। বিগত ১০ বছরে গড়ে একটি করেও অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বতোভাবে আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। বরং দেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার করে আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। আর এর জন্য প্রয়োজন একটি জরুরি ও ব্যাপক জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম, বিশেষ করে অজ্ঞাত বা অল্পভাবে জ্ঞাত এলাকায়-যেমন সমুদ্রবক্ষ। জাতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী সংস্থা বাপেক্স অতি সম্প্রতি ভূখণ্ডে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যার সাফল্য নির্ভর করবে আধুনিক প্রযুক্তির পর্যাপ্ত ও দক্ষ ব্যবহারের ওপর।
বাংলাদেশ ২০১২ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ সার্থকভাবে মেটাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্রবক্ষে প্রায় ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় নিষ্কণ্টকভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যথেষ্ট সন্তুষ্টির কারণ বটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে সমুদ্র বিজয় উৎসব ছিল ব্যাপক, বিশেষ করে সরকারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে যখন নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা সম্পর্কে ব্যাপক আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু তারপর বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও কেন বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর তৎপরতা শুরু করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। পেট্রোবাংলা সমুদ্রবক্ষে একটি সাইসমিক জরিপের (মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে) মাধ্যমে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের একটি উদ্যোগ নেয়, যা কিনা সমুদ্রবক্ষে বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। এ লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে যোগ্য সার্ভিস কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় কিন্তু যোগ্য কোম্পানি বাছাই হওয়ার পর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি আটকে যায়। প্রশাসনযন্ত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যে একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করতে পারে, এটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ওদিকে ২০১২ সালের সীমানা মীমাংসার পর মিয়ানমার তার সমুদ্রবক্ষে জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে। ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োগ করার ফলে চার বছরের মধ্যেই রাখাইন সমুদ্রবক্ষে বেশ কটি বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে একটি গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার সমুদ্র সীমানার সন্নিকটে অবস্থিত। ভূবিজ্ঞানীরা মত দিচ্ছেন যে মিয়ানমারের রাখাইন সমুদ্র অঞ্চল এবং বাংলাদেশের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন সমুদ্র অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে অবিভাজ্য ও উভয়েই একই বেসিনের অন্তর্ভুক্ত। আর সেহেতু এই দুটি অঞ্চলের তেল-গ্যাস বিজ্ঞানের সূত্রসমূহ একই সুতায় বাঁধা। বস্তুত বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষের দক্ষিণ-পূর্ব অংশটি সর্বাপেক্ষা গ্যাস সম্ভাবনাময় বলে ভূবিজ্ঞানীরা যে মত প্রকাশ করছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার ঠিক ওপারে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রসমূহ তার প্রমাণ। বাংলাদেশের এ রকম সমূহ সম্ভাবনাময় এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান না করে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাসের চাহিদা মেটানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জাতীয় স্বার্থে সহায়ক হবে বলে মনে করা যায় না।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে দিনাজপুরে নিজস্ব কয়লাভিত্তিক একমাত্র কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র (৫০০ মেগাওয়াট) বছরে অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টন কয়লা ব্যবহার করে। নিকট ভবিষ্যতে দেশে মহেশখালী, কক্সবাজার, পটুয়াখালী প্রভৃতি এলাকাসহ অনেক স্থানে বাস্তবায়নরত ও পরিকল্পিত বৃহৎ আকারের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (মোট ৯ হাজার মেগাওয়াট) চালু হলে দেশে কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে প্রায় তিন কোটি টন। আর এ কয়লার পুরোটাই আনা হবে দূরবর্তী দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে। আর এই কয়লার আমদানিমূল্য ছাড়াও দেশে এত বিপুল পরিমাণ কয়লা আনা ও পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের খরচ জোগান দেওয়ার ভার দেশকে নিতে হবে।
বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে অন্তত চারটি স্থানে বড় আকারের কয়লা মজুত রয়েছে, যার কেবল একটি (বড়পুকুরিয়া) সীমিত আকারে খনন ও উত্তোলন করা হয়। অন্য সব কয়লার মজুতসমূহ উন্নয়ন করলে সম্মিলিতভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কয়লা জোগান দিয়ে আমদানীকৃত কয়লার ওপর ভার যথেষ্ট কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু দেশের নিজস্ব কয়লা উন্নয়ন করার জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম লক্ষ করা যায় না। একসময় দেশের কয়লা উন্নয়নে উন্মুক্ত খননপদ্ধতি অবলম্বন করার প্রস্তাব বিতর্কিত হয় এবং তা সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় আকারের উন্মুক্ত কয়লা খনন জটিল এবং তা পরিবেশবান্ধব নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ খননপদ্ধতি অবলম্বন করে কয়লা উন্নয়নে কোনো বাধা নেই। উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ খনি থেকে সন্তোষজনক পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। জ্বালানির জোগান দিতে আমদানি-নির্ভরতা কমানোর সব পথই বাংলাদেশকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।