আবেদ ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আমার ব্র্যাক-জীবন। একবার তাঁকে বলেছিলাম, আবেদ ভাই, আমার নিজ বাবার সঙ্গে আমি ৩৩ বছর কাটিয়েছি আর আপনার সঙ্গে ৪২ বছর। শুনে কিছু বলেননি। হয়তো মনে মনে বলেছিলেন, এ রকম অনেকের সঙ্গেই তো ওনার ওঠা-বসা। আসলেই তা-ই। আবেদ ভাই একজন বন্ধুবৎসল মানুষ। যাঁরা একবার বন্ধু হয়েছেন, তাঁরা আজীবনই রয়ে গেছেন। ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ ফজলে আলী, সৈয়দ হুমায়ুন কবির, মনোয়ার হোসেন, ফারুক চৌধুরী প্রমুখ। সেই হিসেবে কিন্তু আমরা বন্ধু ছিলাম না। আমি ছিলাম তাঁর অধীন এক ব্র্যাক কর্মী। তাঁর গুণমুগ্ধ। আজ এই বিরহের সময় অনেক কিছুই মনে পড়ছে, তাঁর চরিত্রে একটা ম্যাজিকেল আকর্ষণ ছিল। যেন এক পরশমণি। যেই তাঁর সংস্পর্শে এসেছে প্রায় সবাই বিমুগ্ধ হয়েছে। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
আবেদ ভাই ছিলেন জ্ঞানের আধার, জ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তাঁর দখল ছিল না। ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি বা উন্নয়ন। তাঁর ছিল এক অসাধারণ কমনসেন্স। ১৯৭৭ সালে ব্র্যাকে যোগদান করে প্রথমেই গেলাম সিলেটের শাল্লা-ব্র্যাকের প্রথম প্রকল্পে। প্রতি মাসেই একবার আবেদ ভাই এই অজপাড়াগাঁয়ে আসতেন মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম দেখতে। দিনের বেলা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আর সন্ধ্যা থেকে শেষ রাত অবধি কর্মিসভা। মাঠপর্যায়ের কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ। আবেদ ভাই কর্মীদের কথা শুনতেন আগ্রহভরে। তারপর তাঁর নিজের মতামত। সহকর্মীরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনতেন এবং একমত হতেন। এইভাবেই ব্র্যাক এগিয়েছে। বিশ্বের ১ নম্বর উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এই বছরের গোড়ার দিকে আমি ব্র্যাক ছেড়ে দিই। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আবেদ ভাই আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তাঁর অফিসে ঢুকতেই বসতে বললেন। চিরাচরিতভাবে। তারপর যা বললেন, যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বলেন, ‘আমার ক্যানসার হয়েছে। জন ম্যাককেইন ও টেড কেনেডির যেটা হয়েছিল, ঠিক সেটাই। আমাকে বলা হয়েছে আমি আর বড়জোর চার থেকে ছয় মাস আছি।’ তাঁর মুখে তেমন কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি লক্ষ করলাম না। আসলে এই ছিলেন আবেদ ভাই। তাঁর ছিল এক অদম্য মনোশক্তি। সমস্যা যত বড়ই হোক খুব সহজেই তিনি সেটা মোকাবিলা করে তার থেকে এগোনোর পথ খুঁজতেন। আরও বললেন যে এই কয়েক মাসে তিনি ব্র্যাকে অনেকগুলো পরিবর্তন আনতে চান, যা ব্র্যাকের ভবিষ্যতের পথচলায় কাজে লাগবে। সেগুলোর একটা বর্ণনাও দিলেন। কোনো কিছু করতে চাইলে তিনি সেটা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়িত করতেন। ১৯৯৯ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বাংলাদেশ ‘এডুকেশন ওয়াচ’-এর প্রথম প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন। ‘ওয়াচ’ দেশীয় সুশীল সমাজের একটি উদ্যোগ। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী। বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী এই উদ্যোগের, বিশেষ করে অত্র রিপোর্টের কড়া সমালোচনা করলেন, যার বেশির ভাগই ছিল নিতান্তই মনগড়া। আমরা যাঁরা প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম (যেমন রাশেদা কে চৌধূরী এবং সমীর নাথ) তাঁরা সবাই খুবই হতাশা অনুভব করছিলেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন আবেদ ভাই। সমাপনী বক্তৃতায় তিনি জোরেশোরে প্রধান অতিথির বক্তব্য খণ্ডন করলেন এবং আরও ঘোষণা করলেন যে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ এই উদ্যোগ চালিয়ে যাবে। এই কঠোর অবস্থানের ফলে আজও এডুকেশন ওয়াচ একটি সফল কার্যক্রম হিসেবে তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছে এবং বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রাখছে।
আবেদ ভাইয়ের জ্ঞানভান্ডার নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তিনি ছিলেন একটি লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া। যেকোনো বিষয়ের ওপরই ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। ২০১৩ সালে চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বাংলাদেশের ওপর একটি প্রকাশনা বের করে, যাতে বাংলাদেশ যে উন্নতি সাধন করেছে, তার ফিরিস্তি দেওয়া হয়। বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে এই প্রকাশনা একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে, বিধায় আমরা বিশ্বের কয়েকটি রাজধানীতে যাই। এ উদ্দেশ্যে নরওয়ের অসলোতে গিয়ে পৌঁছালাম আমরা তিনজন—আবেদ ভাই, আব্বাস ভূঁইয়া ও আমি। নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বড় কর্মকর্তা আমাদের স্বাগত জানান। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাচ্ছি। গাড়ি চালাচ্ছিলেন ওই কর্মকর্তা আর তাঁর পাশে বসা আবেদ ভাই। পেছনের সিটে আমরা বাকি দুজন। গাড়ি চালাতে চালাতে নরওয়ের ভদ্রলোক অসলোর ইতিহাস নিয়ে কিছু বলা শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আবেদ ভাই যোগ দিলেন। বলতে লাগলেন নরওয়ে তথা সব নরডিক দেশের আদিকাল এবং কীভাবে যুদ্ধবিগ্রহ আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ভদ্রলোক তো থ। বললেন, ‘স্যার আবেদ, আপনার এই গভীর জ্ঞানভান্ডার দেখে আমি খুবই মুগ্ধ। আপনার উচিত হবে আমাদের ইতিহাস বিষয়ে আমাদের আরও লেকচার দেওয়া। নিজেদের সম্পর্কে আমার জ্ঞানের অপ্রতুলতা দেখে আমি খুব লজ্জিত বোধ করছি।’
অক্টোবরের শেষের দিকে আবার দেখা হলো আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে। ব্র্যাকের পরিচালক র্যাশেল কবির ও আমি ঢুকলাম তাঁর কক্ষে। ডিভানে শুয়েছিলেন। রোগটি তখন আস্তে আস্তে জেঁকে বসছে। চোখ বোজা অবস্থায় বসতে বললেন। তাঁকে বললাম যে ব্র্যাকের কৃষির ওপর লেখা নতুন বইটি প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে এবং আমি আশা করছি, বইটি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাঁর হাতে তুলে দিতে পারব। মনে হলো খুব খুশি হলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘জব্বল তারিকের কথা জানো? জিব্রালটারের সেই “রক” যা দেশটিকে তার শত্রুদের থেকে বছরের পর বছর নিরাপদ রেখেছিল? তুমি হলে ব্র্যাকের সেই “রক”। তুমি সারা জীবন তোমার কাজের মাধ্যমে ব্র্যাকের ভাবমূর্তি বাইরের জগতে তুলে ধরেছ। ব্র্যাকের সম্মান বৃদ্ধি করেছ। তোমরাই ব্র্যাককে এগিয়ে নিয়ে গেছ। জানি না আমি ব্র্যাকের জন্য কী করেছি।’ কিন্তু এই শেষ কথাটি আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। আমি মূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম উনি ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। র্যাশেলকে বলে চুপি চুপি বের হয়ে এলাম।
এরপর আরও একবার তাঁর সঙ্গে দেখা। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। কৃষি বিষয়ে ব্র্যাকের অবদানের ওপর লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিন। মূল অনুষ্ঠানে আবেদ ভাইয়ের যোগদান সম্ভব নয়, তাই সবাই গেলাম অ্যাপোলো হাসপাতালে। তাঁকে বইটির একটি কপি দিতে। তখন বেশির ভাগ সময় তিনি ঘুমিয়ে থাকতেন। হঠাৎ জেগে উঠলেন। পাশে বসা রেহানা মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবেদ ভাই, চিনতে পারছেন ইনি কে?’ আমার দিকে তাকালেন এবং একগাল হেসে সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, মোশতাক। আমি আরও এগিয়ে গেলাম এবং বললাম, আবেদ ভাই, আপনার জন্য অ্যাগ্রিকালচার বইয়ের একটি কপি নিয়ে এসেছি। তাঁকে বইটি দেখালাম। একনজর দেখলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ‘ওয়ান্ডারফুল’। তারপরই আবার ঘুমিয়ে পড়লেন!
আবেদ ভাই চলে গেছেন। আমার যত ঋণ সবই ব্র্যাক এবং আবেদ ভাইয়ের কাছে। বিস্তৃত পরিসরে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার চার দশকের কথা লেখার অভিপ্রায় রইল। আবেদ ভাই, আপনি ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন।
মোশতাক চৌধুরী: জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারপারসন