শ্রীলঙ্কায় ৮টি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩৫৯ জন (পরে সরকার জানিয়েছে, আগের হিসাবে ভুল হয়েছিল, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ২৫৩) মানুষের মৃত্যু ও প্রায় ৫০০ মানুষের আহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে ২১ এপ্রিল রোববার। কোনো গোষ্ঠী তাৎক্ষণিকভাবে এসব হামলার কৃতিত্ব দাবি করল না; শ্রীলঙ্কার সরকারি কর্তৃপক্ষ ‘ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াত’ নামের স্থানীয় একটি গোষ্ঠীর নাম বলল। কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বললেন, এমন সমন্বিত ও বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলা চালানো ও রকম ছোট ও স্থানীয় কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে কারা এই হামলা চালাল, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলল দুই দিন ধরে।
২৩ এপ্রিল হঠাৎ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর পাওয়া গেল, এসব হামলার কৃতিত্ব দাবি করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। যেসব সংবাদ প্রতিষ্ঠান এই খবর প্রচার করেছে, তাদের প্রতিটিই বলেছে, এই খবরের উৎস ‘আমাক’ নামের একটি অনলাইন নিউজ এজেন্সি। আমাকের নাম আগেও বহুবার শুনেছি। আইএস কোথাও হামলা চালালে তার কৃতিত্ব দাবি করে বিবৃতি প্রকাশ করে আমাকের ওয়েবসাইট। ২০১৬ সালের জুন মাসে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার খবর ও ভিডিও ফুটেজ প্রচার করেছিল আমাক।
কিন্তু আমি কখনো আমাকের নিজস্ব ওয়েবসাইট খুঁজে পাইনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ‘সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্টস অ্যান্টিটিজ ইনস্টিটিউটের’ (সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ নামে পরিচিত) ওয়েবসাইট থেকে আমাকের খবর পাই। ‘সাইট’ পরিচালনা করেন রিতা কার্তস নামের এক নারী ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট, যিনি একজন ইহুদিবাদী হিসেবে পরিচিত।
আমাক সম্পর্কে উইকিপিডিয়া বলছে, এটি আইএসের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি নিউজ আউটলেট। নিউইয়র্ক টাইমস বলে, আইএসের সঙ্গে আমাকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগ অনেক আগেই আইএসকে ‘ফরেন টেররিস্ট অর্গানাইজেশন’ (এফটিও) হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। গত ২১ মার্চ পররাষ্ট্র বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পররাষ্ট্র বিভাগ আমাক নিউজ এজেন্সি ও আল হায়াত মিডিয়া সেন্টারকেও ফরেন টেররিস্ট অর্গানাইজেশন হিসেবে ঘোষণা করেছে। ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আমাক নিউজ এজেন্সি ও আল হায়াত মিডিয়া সেন্টার আইএসের মিডিয়া উইং বা সংবাদমাধ্যম শাখা। ১৩২২২৪ নম্বর নির্বাহী আদেশে এই তিন সংগঠনকে ‘স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেররিস্ট’ (এসডিজিটি) সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
আমাকের অফিস আছে কি না, থাকলে তা কোথায়, এর সার্ভার কোথায় রাখা হয়েছে, কীভাবে এর ওয়েবসাইটের ডোমেইন নাম কেনা হয়েছে, কে কিনেছে এবং ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের স্বঘোষিত ‘খেলাফতের’ চূড়ান্ত পতন ও সর্বশেষ সিরিয়া থেকে তাদের বিতাড়নের পরও আমাক নিউজ এজেন্সি কীভাবে ‘অ্যাকটিভ’ আছে—এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।
সেই আমাকে গত ২৩ এপ্রিল আইএসের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হলো যে শ্রীলঙ্কায় আত্মঘাতী হামলাগুলো ‘ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের’ কাজ। সন্ত্রাসী হামলার কৃতিত্ব দাবি করতে আইএস সাধারণত দেরি করে না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা দিয়ে দেয়। এমন প্রমাণও আছে যে হামলা আইএস করেনি, কিন্তু তার কৃতিত্ব দাবি করেছে। তাই শ্রীলঙ্কার হামলাগুলোর বিষয়ে তাদের বিলম্বিত ঘোষণা নিয়ে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছে, শ্রীলঙ্কায় হামলার ব্যাপারে আইএস কোনো প্রমাণ হাজির করেনি।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার সরকারি কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত ধরে নিয়েছে, হামলাগুলো আইএস জঙ্গিরাই করেছে। ২৬ এপ্রিল খবর বেরিয়েছে, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা বলেছেন, শ্রীলঙ্কার পুলিশ ১৪০ সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান শুরু করেছে। এ ছাড়া হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৭৬ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইএসের সংশ্লিষ্টতার জল্পনা থেকে এমন একটা কথা শোনা গিয়েছিল যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে একজন সিরীয় নাগরিকও আছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ধারণা ভিত্তিহীন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক।
প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, হামলাকারীদের কেউ কেউ হামলার আগে বিদেশ সফর করে থাকতে পারেন। আবদুল লতিফ মোহাম্মদ জামিল নামের এক আত্মঘাতী হামলাকারীর পরিচয় নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, তিনি প্রথমে যুক্তরাজ্য ও পরে অস্ট্রেলিয়ায় প্রকৌশলবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রীলঙ্কায় ফিরে স্থায়ীভাবে বাস করছিলেন।
আইএসের দিকেই সন্দেহের পাল্লা ভারী। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিনের পর্যবেক্ষণ থেকে সন্দেহটা আরও জোরালো হয়। আমাকের মাধ্যমে আইএস যেসব সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, (বিশেষত হামলার কৃতিত্ব দাবি) প্রচার করে, সেগুলো তারা প্রচার করে কয়েকটি ভাষায়। যথা আরবি, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, রুশ, বাংলা ও উর্দু। আটলান্টিক ম্যাগাজিন ২৪ এপ্রিল লিখেছে, আইএস শ্রীলঙ্কায় হামলার কৃতিত্ব দাবি করে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আরবি, ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় প্রচার করেছে, সেগুলোর মধ্যে তামিল ভাষাও আছে।
তামিল ভাষায় কেন? আটলান্টিক বলছে, এর মানে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিলভাষী মুসলমানদের মধ্যে আইএসের অনেক কর্মী-সমর্থক আছে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে নয়াদিল্লির এক সংস্থার ভাষ্য হলো, প্রায় ১৮০ জন ভারতীয় মুসলমান আইএসে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের বড় অংশই দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলোর বাসিন্দা। সংস্থাটি বলেছে, আইএস যখন সিরিয়া-ইরাকের বিরাট এলাকা দখল করে নিজেদের ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, তখন শ্রীলঙ্কা থেকে ৩২ জন সেখানে গিয়েছিলেন।
আমাদের মনে আছে, আইএস যখন ইরাক ও সিরিয়ায় দখল হারাচ্ছিল, তখন তারা সারা পৃথিবী থেকে জিহাদি মুসলমান তরুণ-যুবকদের তাদের সঙ্গে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়ার আহ্বান বন্ধ করেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যাঁরা সিরিয়ায় যাওয়ার আগ্রহ জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন, তখন আইএস নেতৃত্ব তাঁদের বলছিল, তোমাদের আসার প্রয়োজন নেই, তোমরা নিজ নিজ দেশেই সংগঠিত হও, ‘অপারেশন’ চালাও। তারপর যখন সিরিয়ায় তাদের চূড়ান্ত পতন ঘটল, তখন তারা তাদের কর্মীদের বলল, নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে ‘অপারেশন’ চালাও।
ধারণা করা হচ্ছে, যেসব শ্রীলঙ্কান মুসলমান তরুণ-যুবক আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে সিরিয়া গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা স্বদেশে ফিরেছেন। রোববারের আত্মঘাতী হামলাগুলো তাঁরাই চালিয়েছেন। ২৬ এপ্রিল শুক্রবার প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা বলেছেন, হামলাকারীদের প্রধান বলে তাঁরা যঁাকে সন্দেহ করছেন, সেই জাহরান হাশিম হামলার দিনই নিহত হয়েছেন। তিনি ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াতের নেতা। প্রেসিডেন্টের এই ভাষ্য সত্য হলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আইএস যদি এই হামলা চালিয়ে থাকে, তবে তারা তা করেছে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দিয়ে; পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে যাদের বলা হচ্ছে সাব–কন্ট্রাক্টর। এর আগে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে মুসলমানদের ওপর এক খ্রিষ্টান যুবকের হামলার প্রতিশোধ হিসেবে শ্রীলঙ্কায় আইএসের জঙ্গিরা ইস্টার সানডেতে খ্রিষ্টানদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে অবশ্য প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য সমর্থন করেননি।
শ্রীলঙ্কার পুলিশ ও নিরাপত্তা গোয়েন্দারা হামলাকারীদের ধরা ও তাঁদের আন্তর্জাতিক সংযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর মধ্যে এমন বক্তব্য শোনা গেছে যে শ্রীলঙ্কার হামলাকারীদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারত, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের চরমপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ আছে। আরও একটা ভাষ্য হলো, মালদ্বীপে আইএসের কর্মী-সমর্থকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এমনকি ভারতেও ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দ্বারা এত বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে অনেকেই খুব একটা অবাক হতো না। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ঘটনায় অধিকাংশ লোকই অবাক হয়েছে। কারণ, গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশটাতে মোটের ওপর শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। তা ছাড়া শ্রীলঙ্কায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু, তামিল হিন্দুদের চেয়েও তারা সংখ্যায় কম। আল-কায়েদা, আইএস ও অন্যান্য স্থানীয় ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলোর গোপন তৎপরতার পেছনে সমাজের একটা অংশের যে ধরনের সমর্থন-সহযোগিতা প্রয়োজন হয়, আরব বিশ্ব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং কিছু মাত্রায় বাংলাদেশেও তা ছিল বা এখনো আছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় সে রকম থাকার কথা নয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ লিখেছেন, শ্রীলঙ্কার হামলাগুলো আইএসের ইতিহাসে সর্বাধিক বিধ্বংসী আত্মঘাতী হামলা। এমন হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরনের লজিস্টিক সমর্থন প্রয়োজন হয়। যথেষ্ট পরিমাণে মিলিটারি-গ্রেড বিস্ফোরক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এ রকম শক্তিশালী বোমা তৈরির জন্য ছোটখাটো কারখানার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার হামলাগুলোর পেছনে বেশ বড়, শক্তিশালী ও সুদক্ষ একটা সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক কাজ করেছে।
সিরিয়ায় চূড়ান্ত পতনের পর আইএসের এখন আর কোনো কেন্দ্রীয় ঘাঁটি নেই। কিন্তু সংগঠনটির কর্মীরা ছড়িয়ে পড়েছেন সারা দুনিয়ায়। শ্রীলঙ্কার হামলা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, উদ্বেগের কিছু নেই—এ রকম ভাবলে ভুল করা হবে।
মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
mashiul.alam@gmail.com