আফগান জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় টানা দুই দশক ধরে একটি সুন্দর, সুরক্ষিত ও কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে চেষ্টা করে গেছে এবং যা কিছু অর্জন করেছে, তার সবকিছু মাস কয়েকের মধ্যে ধুলোয় মিশে যেতে দেখা নিঃসন্দেহে বেদনার। গত রোববার কাবুলের পতন এবং প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তালেবানের চূড়ান্ত উত্থান সেই বাস্তবতাকেই সামনে আনল।
দৃশ্যত প্রায় বিনা বাধায় তালেবানের আফগানিস্তানের সমগ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই সবার মনে প্রশ্ন তুলেছে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জোট বাহিনী সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না। আফগান সেনাবাহিনীর ভেঙে পড়া এবং দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহায়ত্ব প্রমাণ করে, মার্কিন বাহিনী আরও বহু বছর ধরে আফগান বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশিক্ষণ দিলেও তারা আদৌ কোনো দিন নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে বাইডেন সন্দিহান ছিলেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তান থেকে মসৃণভাবে বেরিয়ে আসার জন্য ২০ বছর ধরে হাজার হাজার সেনা ক্ষয় করেছে, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলেছে, তালেবানকে ধাওয়ার ওপর রেখেছে, আফগান সেনাবাহিনীকে সব ধরনের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অর্থসহায়তা দিয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে জোরালো করার যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতিও এসেছে, কিন্তু তাকে যথেষ্ট বলা যাবে না। কারণ, যেই মাত্র তালেবান পুরোদমে অভিযান শুরু করল, সেই মাত্র দুই দশক ধরে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের রক্ষায় এতটুকু প্রতিরোধ করারও সাহস পেল না। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানই ঠিকমতো কাজ করেনি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের মিশনে শুরু থেকেই মারাত্মক ত্রুটি ছিল। আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র একটি কেন্দ্রশাসিত সরকারব্যবস্থার অধীনে বোকার মতো কাজ করেছিল। কারণ, এই দেশের অভ্যন্তরীণ জটিল ভৌগোলিক অবস্থা, জাতিগত জটিলতা, উপজাতীয় গোত্রভিত্তিক সমাজ—এসব সেখানে রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করেছে। দেশটির পারিপার্শ্বিক অস্থির পরিবেশ এবং বাইরের হস্তক্ষেপের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতিকে টেকসই হতে দেয়নি।
এ পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানকে আধুনিক বিশ্বের ধারণালব্ধ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যেকোনো চেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই নিরিখে বলা যায়, যে লক্ষ্য পূরণ হওয়ার নয়, তার জন্য বৃথা সময় নষ্ট না করে মার্কিন সেনা সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জো বাইডেনের এ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সঠিক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে গিয়েছিল আল–কায়েদার মূলোৎপাটন করতে। তারা চেয়েছিল আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়ে আল–কায়েদা বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী যাতে আমেরিকা বা তাদের কোনো মিত্রের ওপর আঘাত হানতে না পারে। তাদের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে আল–কায়েদার উপস্থিতি মুছে ফেলা হয়েছে। এমনকি আইএসের কথিত আফগান শাখারও তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। সেই দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কৌশলগত সফলতা অনেকখানি পেয়ে গেছে।
ইত্যবসরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস মোকাবিলায় বৈশ্বিক অংশীদারদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছে এবং অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধেও নিজেদের অনেক বেশি সক্ষম করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০০৫ সালে লন্ডনে বোমা হামলার পর আল–কায়েদা বাইরের দেশে জোরালো কোনো হামলা চালাতে পারেনি। এ কথা ঠিক, তালেবান আবার আল–কায়েদা বা সে ধরনের গ্রুপকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেবে না—এমন কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে সেটি হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কম। তালেবান নিজেরাই এখন ক্ষমতায় বসেছে এবং আল–কায়েদাকে আশ্রয় দিয়ে তাদের আসলে তেমন কোনো লাভও নেই। তালেবান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি চায়। তারা ভালো করে জানে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনকে মদদ দিলে সেই স্বীকৃতি পাওয়া তাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
সে কারণে বাইডেনের সিদ্ধান্ত সঠিক। আমেরিকার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় শিবির বাইরের দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনন্ত যুদ্ধে’ বিরক্ত। এ অবস্থায় আফগানিস্তান যুদ্ধ তাদের কাছে বাড়তি বোঝা। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে এনে ভুল সিদ্ধান্ত নেননি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● চার্লস এ কুপচান জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক