মতামত

আফগানিস্তানে বাংলাদেশ কী ভূমিকা রাখতে পারে

কাবুলে এক চেকপোস্ট পার হয়ে স্কুলে যাচ্ছে আফগান শিশুরা।
ছবি: রয়টার্স

নাটকীয় কোনো পরিবর্তন না ঘটলে মার্কিন দখল-পরবর্তী আফগানিস্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর শিগগির ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে সবাই কাজ করছে। তালেবানদের দাবি অনুসারে আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। দখলকৃত এলাকার পরিসীমা বৃদ্ধির সমান্তরালে কূটনৈতিক তৎপরতাও পরিচালনা করছে তালেবানরা। ওয়াশিংটনের সঙ্গে শান্তিচুক্তি ছাড়াও তেহরান থেকে মস্কো চষে বেড়াচ্ছেন তালেবান প্রতিনিধিরা। বেইজিংয়ের সঙ্গেও সাম্যাবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। তালেবানদের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তুর্কমিনিস্তান ও উইঘুরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তালেবানরা সহায়তা করবে না। মধ্য এশিয়ার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে তালেবানরা সবার সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। সুহাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী অক্ষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন, তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তান নতুন করে সন্ত্রাসী তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে না; বরং শান্তির পথেই হাঁটবে তালেবান।

ঠিক এই জায়গাতেই বাংলাদেশ আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে আমাদের সামাজিক উন্নয়নের মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই ব্র্যাক আফগানিস্তানে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেপ্টেম্বরের মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগান রাজনৈতিক বিন্যাসে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, সহজেই অনুমেয়। কাবুলে জাতীয় সরকার গঠন হতে পারে, তালেবানরা পুরোপুরি দখল করে নিতে পারে অথবা আশরাফ ঘানির সঙ্গে মিলে যৌথভাবে তালেবানরা শাসনক্ষমতা পরিচালনা করতে পারে।

আফগানের নতুন শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশ কীভাবে কাজ করবে, এসব নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে পর আশরাফ ঘানির সরকারের পতন হলে ভারতসহ অনেক উন্নয়ন সহযোগীকেই প্রকল্প কার্যক্রম বাদ দিয়ে চলে যেতে হবে। ইতিমধ্যে হেরাত প্রদেশে ভারত কর্তৃক নির্মিত একটি ড্যাম তালেবানরা দখলে নিয়েছে। যদিও ভারত তালেবানদের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তালেবান প্রতিনিধিদল মস্কো সফরের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শংকর মস্কো সফর করেছেন।

বাংলাদেশ আফগানিস্তানে চারটি খাতে সরাসরি কাজ শুরু করতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা, নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষুদ্র ঋণ এবং কৃষি খাতে। আমাদের এনজিওগুলো আফগান গ্রামে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। শিক্ষকও প্রেরণ করা যেতে পারে। দুর্গম এলাকায় আফগান জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য স্যাটেলাইট ক্লিনিক স্থাপনের সহায়তা করতে পারে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি শুরু করা যেতে পারে। সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপনে সহায়তা করতে পারে বাংলাদেশ সরকার। এসবের পাশাপাশি কৃষি খাতের উন্নয়নে স্থানীয় পর্যায়ে সেচপদ্ধতির উন্নয়ন, বীজ সংরক্ষণ ও বিতরণ এবং কৃষিপণ্য বিপণনে আমরা আফগানিস্তানকে সহায়তা করতে পারি। গত কয়েক দশকে আমাদের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো অভূতপূর্ব উন্নতি ও দক্ষতা অর্জন করেছে। আমাদের সামাজিক উন্নয়নের মডেল সারা বিশ্বেই সমাদৃত। এই মডেল এখন আফ্রিকার অনেক দেশেই প্রয়োগ করা হচ্ছে।

আমাদের ব্যবসায়ীরা আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করতে পারে। নতুন শাসনব্যবস্থায় সেখানে প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। দেশের স্টিল ও সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে কারখানা স্থাপন করতে পারে। খনিশিল্পে জনবল প্রেরণ করতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য চিকিৎসকেরা যেতে পারেন।

বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ নিজেই অর্থায়ন করতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক রিজার্ভ এখন বেশ ভালো। বাংলাদেশ আফগানিস্তানকে ঋণ দিতে পারে। ঋণ প্রদানে চীনা মডেল অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ। ধরা যাক, বাংলাদেশ আফগানিস্তানকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। কিন্তু শর্ত থাকবে বাংলাদেশি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। অথবা বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক বা চীনের মতো দেশ থেকে ঋণ পেতে মধ্যস্থতা করতে পারে। মোদ্দাকথা হচ্ছে সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে আফগানিস্তানে শান্তির সুযোগ বিকশিত করতে হবে। এটা পাকিস্তান বা ভারতের পক্ষে করা সম্ভব না। পাকিস্তানের সামাজিক উন্নয়ননীতি বাস্তবায়নের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। তালেবানবিরোধী হওয়ার ভারতের পক্ষেও কাজটি কঠিন। ভারত ইতিমধ্যেই কান্দাহার থেকে কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করেছে।

সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের ব্যবসায়ীরা আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করতে পারে। নতুন শাসনব্যবস্থায় আফগানিস্তানে প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। স্টিল, সিমেন্টের প্রয়োজন হবে। দেশের স্টিল ও সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে কারখানা স্থাপন করতে পারে। খনিশিল্পে জনবল প্রেরণ করতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য চিকিৎসক ও সেবিকারা যেতে পারেন। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আফগানিস্তানে উচ্চশিক্ষার প্রসারে কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে খনিজ কাঁচামাল ও বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে পারি আমরা। নতুন আফগান সরকারের সঙ্গে উভয়মুখী বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপনে সামাজিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক মডেল প্রয়োগে বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। আমাদের সমাজের এর গভীর প্রভাব থাকবে। দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও কট্টরপন্থার উত্থানের যে শঙ্কা করা হয় বিভিন্ন পক্ষ থেকে তা স্তিমিত করা সহজ হবে। গত দিন দশকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় কট্টরপন্থার বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তালেবান। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে তালেবানের হাতে কাবুলে উত্তরাঞ্চলীয় জোট সরকারের পতনের পরপরই অন্যান্য দেশে তালেবান ধাঁচের ধর্মীয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বর্তমান বাস্তবতায় অর্থনৈতিক কারণে তালেবানরা বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় দলগুলোকে সমর্থন করার পুরোনো কৌশল পরিবর্তন করবে। এমনিতেও তালেবানরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। তালেবানদের কূটনীতি এখন অনেক পরিণত ও কৌশলী মনে হচ্ছে। তালেবানরাও এখন কৌশল প্রয়োগ করে সাম্যস্থায় অবস্থায় থাকতে চায়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে তালেবানরা আগের থেকে অনেক বেশি নমনীয়।

আফগাননীতিতে বাংলাদেশকে রাশিয়া ও চীনের ছায়ায় থেকে তালেবানদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে তালেবানরা ধারাবাহিকভাবেই খুবই কট্টর ও রক্ষণশীল। ওইখানে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ আফগানিস্তানের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কেবল কাজ করবে। আফগানিস্তান বৃহৎ শক্তির মৃত্যুকূপ। বৃহৎ শক্তিকে পরাভূত করেই তালেবানরা টিকে আছে। তালেবানরা বিভিন্ন সময় মিত্র বদল করলেও তাদের সঙ্গে কোনো বৃহৎ শক্তিই পেরে ওঠেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমল থেকেই আফগানিস্তানে শক্তি প্রয়োগ করে কেউ সফল হয়নি।

বিরুদ্ধ পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশি সামাজিক উন্নয়ন মডেল পরীক্ষার ক্ষেত্র হতে পারে আফগানিস্তান। মূলত, বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ও প্রয়োগকৃত সামাজিক উন্নয়ন মডেলের কার্যকারিতা ভিন্ন পরিসরে পরখ করা সম্ভব হবে। ধর্মীয় নৈকট্যের কারণে বাংলাদেশের জন্য আফগানিস্তানে কাজ করা সহজ হবে। বাংলাদেশ হতে পারে শান্তি স্থাপনের নতুন আন্তর্জাতিক মডেল। দেশের ভাবমূর্তিও আরও উজ্জ্বল হবে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক