আফগানিস্তানে চতুর্মুখী চাপে যুক্তরাষ্ট্র

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য

এপ্রিলের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং সেনা ফিরিয়ে নিতে গড়িমসি করছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় সম্পাদিত শান্তি চুক্তির শর্তানুসারে তালেবান সন্ত্রাস পরিহার করলে মার্কিন সেনারা ফিরে যাবে। গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৈন্য প্রত্যাহার করা নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন। বাইডেনের এ মন্তব্যের পর শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

সিআইএ আশঙ্কা করছে, সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবান শুধু ক্ষমতাই দখল করবে না, আল-কায়েদা, আইএস ও ইসলামিক স্টেট খোরাসানের পুনরুত্থানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। সিআইএ ট্রাম্প প্রশাসনের মতো তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরে সৈন্য প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। ফাঁকে ফাঁকে বন্দীদের নিয়ে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা হবে। উভয় পক্ষই বিরতি নিয়ে এদিকে-সেদিকে হামলা অব্যাহত রাখবে। তালেবান ঘোষণা দিয়েই রেখেছে, চুক্তি অনুসারে সৈন্য ফিরিয়ে না নিলে নতুন করে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তাই সিআইএর পরামর্শ মার্কিন প্রশাসন মেনে নিলে সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে না। বাইডেনের বক্তব্যে অনেকে এমন আভাসই পাচ্ছেন।

আফগানিস্তানে প্রতিটি নতুন হামলা যুক্তরাষ্ট্রকে কালক্ষেপণের সুযোগ করে দেবে। কারণ, আল-কায়েদা বা আইএসের উত্থানের শঙ্কার কথা তো সিআইএ বলেই রেখেছে।
ফলে চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান উভয় পক্ষই পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কার কথা জানাচ্ছে। শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জালমেই খালিলজাদ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্য থেকে প্রতিনিধি রাখার জন্য তিনি তৎপরতা চালাচ্ছেন। কিন্তু সরকার বা তালেবান—কোনো পক্ষই খালিলজাদের এ প্রস্তাব মেনে নেয়নি।

তবে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়িত না হলেও আফগানিস্তানে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা কম। কারণ, চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে রাশিয়া। গত মাসে মস্কোতে তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। আলোচনায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আফগান পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হচ্ছে রাশিয়া, চীন ও ইরান। অন্য কেউ নয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সিরিয়ার পর আফগানিস্তানেও রাশিয়া ও ইরানের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন। পরিণতিও সম্ভবত সিরিয়ার মতোই হবে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে ধরে রাখতেও পারছে না, আবার ছাড়তেও পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করুক বা না করুক, আফগানিস্তান-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত এককভাবে আর নিতে পারবে না। ২০০১ সালে তালেবান ছিল একা। এখন রাশিয়া, চীন ও ইরান তালেবানকে সমর্থন দিচ্ছে। বিশেষ করে তালেবান বিষয়ে রাশিয়া ও ইরানের অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন হয়েছে। আফগানিস্তান বিষয়ে অনেক দিন ধরেই রাশিয়া, ইরান ও চীনকে যুক্ত করতে চাইছিল তালেবান। রাশিয়া ভালোভাবেই সক্রিয় হয়েছে। চীনও তালেবানের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।

অন্যদিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি মস্কো, বেইজিং ও তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল তালেবান। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনা বাতিলের ঘোষণা দিলে রাশিয়া, চীন ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তালেবান। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটাই সফল। তালেবান নেতারা একাধিকবার মস্কো, তেহরান ও বেইজিং সফর করেছেন। এমনকি শোনা যায়, ইসলামিক স্টেট খোরাসানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তালেবানকে অস্ত্রও দিয়েছিল রাশিয়া। যদিও উভয় পক্ষ অস্বীকার করেছে।

শেষ মুহূর্তে তাই শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে মধ্যস্থতা করতে পারে রাশিয়া। অথবা মার্কিন সৈন্য রেখেই নতুন কোনো পথ বের করতে পারে। রাশিয়ার মতামতকে বিবেচনায় নিয়েই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। ইতিহাসের নির্মম রসিকতা হচ্ছে, গত শতকের আশির দশকে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। প্রায় ৪১ বছর পর এবার তালেবান ও রাশিয়া মিলে যুক্তরাষ্ট্রকে বিতাড়নের ফন্দি আঁটছে। কারণ, তালেবানের পেছনের উঠানে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর উপস্থিতিকেই বড় হুমকি মনে করছে রাশিয়া।

ওদিকে অনেকটা নীরবেই আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে চীন। তালেবান কখনোই আফগানিস্তানে চীনের বিনিয়োগের ওপর হামলা করেনি। এমনকি উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনাদের অত্যাচার-নির্যাতন নিয়েও প্রকাশ্যে কথা বলেনি।

ইরানও শিয়া-সুন্নির হিসাব বাদ দিয়ে তালেবান বিষয়ে এখন অনেকটাই নমনীয়। ইরানের অবস্থাও রাশিয়ার মতোই। ঘরের কাছে মার্কিন উপস্থিতির থেকে তালেবানকে অধিকতর নিরাপদ মনে করে ইরান।

এ অবস্থায় রাশিয়া, ইরান ও চীনের চাপের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আফগান যুদ্ধের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের নানা হিসাব ছিল। মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজস্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইরানের ঘাড়ের ওপর বসে নিশ্বাস ফেলতে চেয়েছিল।

কিন্তু নির্বিচারে সাধারণ নাগরিক হত্যা, হাজার হাজার টন বোমা বর্ষণের পর মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেই উদ্দেশ্য এখন অনেকটাই নড়বড়ে হতে শুরু করেছে। ‘শত্রুর শত্রু মানে আমাদের বন্ধু’—এ নীতিকে অবলম্বন করে রাশিয়া, চীন ও ইরান তালেবানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াতে চাইছে। এত অর্থ, অস্ত্র ও শ্রম ব্যয় করে শেষ পর্যন্ত তালেবান এবং রাশিয়া, ইরান ও চীনের হাতে আফগানিস্তানকে সঁপে দিয়ে ফিরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কষ্টকরই বটে।

মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক