১১ জানুয়ারি জাতিসংঘ জরুরি ত্রাণবিষয়ক সমন্বয়ক মার্টিন গ্রিফিথস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তার জন্য ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার তহবিল জোগানের আহ্বান জানান। জাতিসংঘ বলেছে, এ পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, আফগানিস্তানের জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো যাতে পূরণ করা যায়। এ বছরে যদি চাহিদামতো অর্থসংস্থান না করা যায়, তবে আগামী বছর ১০ বিলিয়ন ডলার অর্থ সেখানে প্রয়োজন হবে। ১০ বিলিয়ন ডলার সংখ্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের দেশের ব্যাংকে রক্ষিত আফগানিস্তানের ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার সম্পদ জব্দ করে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আফগানিস্তানের আরও ৪৫৫ মিলিয়ন ডলার আটকে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ব্রায়াড সম্প্রতি তাঁর লেখা ‘আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট থেকে কী করে উত্তরণ হবে’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, আফগানিস্তান এখন যে সংকটের মুখে পড়েছে, সেটা সরাসরি দুটো কারণে হয়েছে। প্রথমত, দেশটির বার্ষিক আট বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘বৈদেশিক বিনিময় রিজার্ভ’-এ থাকা আফগানিস্তানের ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার জব্দ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন এই অর্থনীতিবিদ আরও উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পাশাপাশি সেখানকার ব্যক্তিগত ব্যবসা ও বাণিজ্যিক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া প্রয়োজন। আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষকসহ অত্যাবশ্যকীয় সেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার উপায় খুঁজতেও বলেছেন। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের রাজস্ব ও সহযোগিতা তহবিলের সমন্বয় সাধনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
২০২০ সালের জুলাই মাস। তখনো কোভিড-১৯ মহামারি আফগানিস্তানে বড় পরিসরে আঘাত করেনি এবং তালেবান দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়নি, সে সময়েই আফগানিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেটা দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে। ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেখানে ২ দশমিক ৩১৩ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। কিন্তু বিপুল এ অর্থের মধ্যে মাত্র ১৪৫ বিলিয়ন তারা ব্যয় করে আফগান পুনর্গঠনে।
২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) আফগানিস্তানের শোচনীয় পরিস্থিতি নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত এক দশকে আফগানিস্তানের বার্ষিক মাথাপিছু আয় কমেছে। ২০১২ সালে যেখানে মাথাপিছু ৬৫০ ডলার আয় ছিল, সেখানে ২০২০ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৫০০ ডলার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি একই হারে বাড়তে থাকে, তাহলে ২০২২ সাল নাগাদ সেটা ৩৪০ ডলারে নেমে আসতে পারে। ২০২২ সালে জিডিপির সংকোচন হবে ২০ শতাংশ।
ইউএনডিপির প্রতিবেদন থেকে আফগানিস্তানের মানবিক সংকটের ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। ‘সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, আফগানিস্তানে কেবল ৫ শতাংশ মানুষের হাতে পর্যাপ্ত খাবার আছে। তীব্র ক্ষুধার মুখোমুখি হয়েছে—এমন মানুষের সংখ্যা এখন ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছেছে। এই শীতে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ শিশু খাদ্য অনিরাপত্তার মুখে পড়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩৫ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। আর ১০ লাখ শিশু ক্ষুধা ও কম তাপমাত্রায় মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে।’
আফগানিস্তানে মানবিক কার্যক্রম শুরু এবং ক্ষুধা থেকে জনগণকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ এখন সেখানকার তীব্র শীত মৌসুম। তুষারের কারণে ইতিমধ্যে সেখানকার অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। নভেম্বরে আফগানিস্তানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ফের খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে এখানকার মানবিক সংকটের দায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে। আমাদের দেশে যে ক্ষতি তারা করেছে, সেটা পূরণে ভূমিকা পালন করতে হবে।’
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
● বিজয় প্রসাদ ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও লেখক