‘আপ’ সাফল্যে রাজনীতির রং বদলে যেতে পারে ভারতে

অরবিন্দ কেজরিওয়াল
অরবিন্দ কেজরিওয়াল

ভারতের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই উত্তর প্রদেশ। এ রাজ্যে উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ২০২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক ভাগ্য। শুধু তা-ই নয়, এই পাঁচ রাজ্যের ফলাফল ঠিক করে দেবে ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার ভারসাম্য কেমন হবে এবং জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শাসকদলীয় প্রার্থীর উতরে যাওয়া মসৃণ হবে কি না। এ ভোট নির্ধারণ করবে পাঁচ রাজ্যের ৬৯০ আসনের চরিত্র। এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রাজ্যসভার ৭৫টি আসন খালি হবে। তার মধ্যে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড ও পাঞ্জাবের ১৯টি। বিজেপির আসন কমার অর্থ বিরোধীদের শক্তি বৃদ্ধি। মনে রাখতে হবে, ভারতের রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করেন বিধানসভা ও সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যরা।

অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পরবর্তী রাষ্ট্রপতির ভাগ্যও। সেই সঙ্গে অবশ্যই শাসক বিজেপিরও। কারণ, এবারের ফলাফল বুঝিয়ে দেবে ২০২৪-পরবর্তী বিজেপির বোলবোলাও কেমন থাকবে। স্বাভাবিক কারণেই এবারের এ ভোটপর্ব ঘিরে উত্তেজনার পারদ চড়ছে নিত্য। সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ জল্পনাও। এসবের মধ্যেই জন্ম নতুন এক আকর্ষণের। তার কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল আম আদমি পার্টি, ২০১২ সালের নভেম্বরে আত্মপ্রকাশের পর আজ সারা দেশে যারা ‘আপ’ নামে পরিচিত।

আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল কীভাবে অন্য সহযোগীদের পেছনে ফেলে আম আদমি পার্টির জন্ম দিয়েছিলেন, সবার তা জানা। আন্না হাজারে চাননি তাঁর অনুগামীরা সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ুন। কেজরিওয়াল তা মানেননি। তাঁর যুক্তি ছিল, রাজনীতিকে স্বচ্ছ করতে হলে ‘সিস্টেম’-এর ভেতরে গিয়ে করতে হবে। বাইরে থেকে লাভ হবে না। ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা সাড়া ফেলে দেয় দ্বিতীয় গরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে এসে। ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় কংগ্রেসের পরোক্ষ সমর্থনে সরকারও গড়ে। কিন্তু ৪৯ দিন সরকার চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল পদত্যাগ করেছিলেন প্রতিশ্রুতিমতো ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করাতে না পারায়। তাতে শাপে বর হয়েছিল, কারণ ২০১৫ সালের ভোটে তারা জেতে ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসন। পাঁচ বছর পর ২০২০ সালেও তারই পুনরাবৃত্তি। আপ পায় ৬২টি আসন।

সেই থেকে দিল্লিতে অজেয় আপ এই প্রথম সাড়া জাগিয়ে অন্যত্র শাখা-প্রশাখা বিস্তারে কোমর কষে নেমেছে। উত্তর প্রদেশ ও মণিপুর বাদ দিলে পাঞ্জাবে তারা কংগ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। গোয়া ও উত্তরাখন্ডে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনাও তাদের রয়েছে। অল্প দিনে এই সমীহ আদায়ের পেছনে রয়েছে তাদের কৌশল, যা তিন রাজ্যেই পৃথক।

পাঞ্জাবে আপ কয়েক বছর ধরেই সক্রিয়। এই রাজ্যের রাজনীতি এযাবৎ যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন, সেই বড় ভূস্বামীদের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে আপ সংগঠিত করতে চেয়েছে দলিত, অনগ্রসর ও প্রান্তিক মানুষকে। মনে রাখতে হবে, ভারতের শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত এই রাজ্যে প্রান্তবাসীর সংখ্যা ৩২ থেকে ৩৩ শতাংশ। অথচ রাজ্য গঠনের পর দলিত-অনগ্রসরদের কেউ কোনো দলের শীর্ষে উঠে মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। আপ সেই জায়গা পূরণ করতে চায় বুঝে জাট ভূস্বামী অমরিন্দর সিংয়ের বিকল্প হিসেবে কংগ্রেস এই প্রথম তুলে ধরেছে দলিত ‘আম আদমি’ চরণজিৎ সিং চান্নিকে। কংগ্রেস ও আপ সেই অর্থে এই রাজ্যে একে অন্যের পরিপূরক হয়েও আদতে প্রতিদ্বন্দ্বী। লড়াইটা এই রাজ্যে তাই এমন জমকালো।

গোয়ার রাজনীতি বরাবর জাতীয় পর্যায়ের দুই শক্তি কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। ভারসাম্য রক্ষার কাজ করেছে স্থানীয় কিছু দল। এই রাজ্যের রাজনীতিতে ‘দুর্নীতিবাজ’দের প্রভাব ঠেকাতে এই প্রথম আপ ‘আদর্শ’ ও ‘নৈতিক’ মূল্যবোধ হাতিয়ার করে আটপৌরে আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় নেমেছে। জমি ও খনি মাফিয়া এবং চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত এই রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা স্বাভাবিক নিয়মে যাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আপ মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে যাঁকে বেছে নিয়েছে, সেই অমিত পালেকর স্থানীয় আইনজীবী ও সমাজকর্মী। সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই করে পরিচিতি পেয়েছেন। উত্তরাখন্ডে আপের বাজি স্থানীয় সাবেক সেনানী, অবসরের পর যিনি সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত।

দিল্লির পরিধি ছাড়িয়ে আপ যত বাইরের দিকে এগিয়েছে, ততই ঝরে পড়েছে তাদের আদর্শের নামাবলি। নীতি ও আদর্শের জয়গান গেয়ে কেজরিওয়াল ২০১৪ সাল থেকে হাজারে হাজারে নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবীকে সংগঠিত করেছিলেন। অথচ আজ যাঁরা ক্ষমতার টানে শামিল হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীরাই বেশি। আন্না হাজারের প্রভাবমুক্ত হয়ে কেজরিওয়াল যত ‘বাস্তববাদী’ নেতা হয়েছেন, ততই বদলেছে দলীয় চরিত্র। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী না হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ধর্মীয় মানসিকতায় তিনি বাতাস দিচ্ছেন। নির্বাচনী ইশতেহারে বয়স্ক হিন্দুদের অযোধ্যা, মুসলমানদের আজমির শরিফ ও খ্রিষ্টানদের তামিলনাড়ুর ভেলানকান্নির বিখ্যাত গির্জায় নিখরচায় ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। শাহিনবাগের আন্দোলন থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। জম্মু-কাশ্মীরের সরকারি নীতি সমর্থন করেছেন। বিজেপির ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদের’ বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে আজ তারা নারাজ। পাছে ‘হিন্দু’ মানসিকতায় আঘাত লাগে! যে কেজরিওয়াল একদা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজপথে শুয়ে অনশন করেছিলেন, তিনিই আজ কেন্দ্রীয় আধিপত্য সহ্য করে উপরাজ্যপালের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন। ভোটে জিততে প্রকাশ্যে হিন্দু দেব–দেবীর পূজার মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। আর পাঁচটা দলের সঙ্গে আজকের আপ পার্থক্য শূন্য। বরং বিজেপি ও কংগ্রেসের মতো পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যার জন্ম, পাঁচ রাজ্যের ভোটের প্রাক্কালে আজ সেই আপকে বিজেপির ‘বি টিম’ বলে কটাক্ষ শুনতে হচ্ছে।

তবু কেন এভাবে এত দ্রুত ভিন রাজ্যে সাড়া ফেলেছে এই দল? একটা কারণ, দিল্লিতে তাদের উন্নয়ন ও শাসনের ‘মডেল’। রাজধানী হওয়ার সুবাদে তা সারা দেশে প্রচার পেয়েছে। প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত দিল্লিবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের এই নতুন ‘মডেল’ কেজরিওয়াল সফল করতে পেরেছেন। সেই সঙ্গে দুর্নীতি দূর করতে সাধারণ সরকারি পরিষেবা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেও তিনি সফল। প্রচারের জোরে এই ‘মডেল’-এর খবর পৌঁছে গেছে রাজ্যে রাজ্যে। সেটাই তাঁর দলের জনপ্রিয়তার ভিত।

পাঞ্জাব, গোয়া ও উত্তরাখন্ডে আম আদমি পার্টি কতটা সফল হবে, সেই উত্তর অদূর ভবিষ্যতের গর্ভে। সাফল্য পেলে আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতি রং বদলে চনমনে হয়ে উঠবে। বিজেপির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য জোটের নেতৃত্বদানের প্রশ্নে কংগ্রেসের দাবি অস্বীকার করে হইচই ফেলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে তুলে ধরেছেন জোটের মুখ হিসেবে। তিন রাজ্যে সফল হয়ে আপ বিকশিত হলে সর্বভারতীয় প্রভাবশালী দল হিসেবে তাদের অস্বীকার করা কঠিন হবে। কংগ্রেস নিজের ক্ষয় ঠেকাতে না পারলে বিজেপির বিপ্রতীপে জোটের নেতৃত্বদানের প্রশ্নে কেজরিওয়ালও তখন হয়ে উঠতে পারেন অন্যতম দাবিদার।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি