১০ মে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে পয়লা বৈশােখ নারী লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে একটি ঘেরাও কর্মসূচির ওপর পুলিশ বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। এই হামলার যে সচিত্র বিবরণ প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে, তা দেখে যেকোনো মানুষ বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ না হয়ে পারবে না। দুর্বৃত্তদের হামলার বিচার চাইতে এসে শিক্ষার্থীরা পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হলেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’। পুলিশের আচরণ এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সে রকম। পয়লা বৈশাখে যখন দুর্বৃত্তরা নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তখন সেখানে পুলিশ এগিয়ে আসেনি। কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের লাঠিপেটা করতে তাদের উৎসাহের কমতি নেই।
সেদিন পুলিশ এগিয়ে না এলেও লিটন নন্দী নামের ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতা প্রতিরোধ করেছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি যে একজন নারীকে যখন প্রায় বিবস্ত্র করার চেষ্টা হচ্ছিল, তখন তিনি দুর্বৃত্তদের বাধা দিতে এগিয়ে যান। এতে তাঁর একটি হাতও ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু অদূরে দণ্ডায়মান পুলিশ তখন চুপচাপ দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের কাছে খবরটা জানানো হয়, তখন তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশকে ফোন করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়েও পুলিশ প্রথমে সম্পূর্ণ ঘটনা অস্বীকারের চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে ১২৬টি সিসি ক্যামেরা এবারও ঘটনার ছবি প্রকাশ করে দেয়। যেমন, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডটির ছবিও সিসি ক্যামেরার কারণে অনেকখানি আমরা দেখতে পেয়েছিলাম।
ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, পুলিশের কাছে অন্তত একজন দুর্বৃত্তকে তাঁরা ধরে সোপর্দ করেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। প্রথম আলোতেই প্রকাশিত কাবেরী গায়েনের লেখায় এর বিস্তৃত প্রামাণ্য বিবরণ রয়েছে। কিন্তু পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শুরু থেকেই বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট ছিল। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আয়োজিত অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এক সভায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ‘সাত দিনের মধ্যে, ১০ দিনের মধ্যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ ইত্যাদি হুমকি দিয়ে পুলিশকে আসামি শনাক্ত করে ধরে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে বেশ জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর তাঁরা আর কোনো কর্মসূচি দেননি।
আশ্চর্যের বিষয়, এমন একটি মনুষ৵ত্ববিরোধী লজ্জাকর ঘটনাকে আস্তে আস্তে ভুলিয়ে দেওয়ার, সহনীয় করার, চাপা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহতই রয়েছে। এমনকি বিশেষ একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল এ রকম কথাও বলতে থাকে, পয়লা বৈশাখে ‘ইসলামি পোশাক’বর্জিত এই নারীদের ওপর হামলার জন্য তাঁরা নিজেরাই দায়ী। আবার আরেকটি মহল মনে করে, ‘ছাত্রলীগের কর্মীরাই’ এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থেকেছে।
কোনটি সত্য—প্রথমটি, না দ্বিতীয়টি? সরকারকে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে, নাহলে উপরিউক্ত দুটি অভিযোগের একটিকে মানুষ সত্য বলে ধরে নেবে।
পয়লা বৈশাখের ঘটনায় পুলিশ প্রথম থেকেই সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে আসছে। তাদের বক্তব্য ‘কেউ তো অভিযোগ করতে এগিয়ে আসেনি’, ‘আমরা সাক্ষী পাব কোথা থেকে’, ‘একমাত্র লিটন নন্দীই তো সাক্ষী দিয়েছে’ ইত্যাদি। কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন যে ছবিগুলো ভূতের ছবি নয়। আর এসব ক্ষেত্রে সেই হামলার শিকার মেয়েটি যদি সাহস করে আজ অভিযোগ করতে এগিয়ে না আসেন, আমরা সেটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না।
আশার দিক হচ্ছে, বিভিন্ন নারী সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মীরা নারী লাঞ্ছনার বিষয়টি ভুলতে দেয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ বন্ধুরা সরকার ও প্রশাসনের নিশ্চুপ ভূমিকার প্রতিবাদ জানাতে মিছিল বের করেছেন রাজপথে। ডিএমপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সেখানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘এখানে যতসংখ্যক পুলিশ আমাদের বাধা দিচ্ছে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে তারা থাকলে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটত না’ (প্রথম আলো, ১১ মে, ২০১৫)।
তাদের এই কর্মসূচির নামকরণ ছিল ‘পাল্টা আঘাত’। ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ কর্মীরা বিচার না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়েই এই কর্মসূচি নিয়েছেন। অনেক দিন তাঁরা অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু পুলিশ অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। কতখানি ছাত্র ইউনিয়ন এই কর্মসূচি নিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন জনগণকে আহ্বান জানান যে ‘জ্বালাও-পোড়াওয়ের সংঘটকদের’ হাতেনাতে ধরে শাস্তি দিতে, তখন এই আহ্বানও সমান যুক্তিসংগত যে ‘নারীর বস্ত্রহরণকারীদের’ ধরে জনগণই শাস্তি দিক। ছাত্রসমাজকে আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ ক্ষেত্রে তাই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা কোনো অন্যায় করেননি।
পুলিশ দাবি করেছে যে ছাত্র ইউনিয়নের প্রায় ২০০ কর্মী রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিলেন। সুতরাং, লাঠিপেটা করে তাঁদের সরিয়ে রাস্তা উন্মুক্ত করার দায়িত্বই তারা পালন করেছে মাত্র। যদি সেটুকু করে তারা ক্ষান্ত হতো, তাহলে হয়তো বলা যেত যে তারা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু এখানেও ছবি অন্য কথা বলে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়নের এক ছাত্রী কর্মী গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর রাস্তা থেকে সব ছাত্রছাত্রী ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন, রাস্তা পরিষ্কারও হয়ে গেছে। তার পরও পুলিশ ওই ছাত্রীকে টেনেহিঁচড়ে সামনে এনে পেটাচ্ছে। এই চিত্র একধরনের পশুশক্তিকেই তুলে ধরে, মনুষ্যত্বকে নয়। প্রথম আলোর সাংবাদিক তাই বিস্ময়সহকারে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘নারী লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের দমনে পুলিশ এত মারমুখী হলো কেন?’ সংগত কারণেই তিনি হয়তো নিশ্চুপ থেকে বলেছেন, ‘রমনা বিভাগের উপকমিশনারের’ সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস খুবই উজ্জ্বল। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির একটি বড় অংশ ‘হন্ডা-গুন্ডা-অর্থবাণিজ্য’ ইত্যাদির পঙ্কে ডুবে গেছে বা তাদের ডোবানো হয়েছে। আরেকটি বড় অংশ ‘রগকাটা শিবিরের’ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এসবের মধ্যেও যে ক্ষীণ বামপন্থী ছাত্ররাজনীতির ধারাটি এখনো সুস্থ ও সুন্দর আগামীর জন্য লড়াই করে চলেছে, তাদেরই অন্যতম প্রতিনিধি হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। আমি তাদের মানবিক অনুভূতি ও নারী লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়াসকে অভিনন্দন জানাই। তাদের এই আঘাতে দমে না যাওয়ার আহ্বান জানাব। রবীন্দ্রনাথের সেই ‘স্ফুলিঙ্গটি’ তাদের উদ্দেশে পুনরায় নিবেদন করব।
‘আপনারে দীপ করি জ্বালো,
আপনার যাত্রাপথে
আপনিই দিতে হবে আলো।’
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
akash92@hotmail.com