আন্তর্জাতিক সূচকগুলোতে ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশের যত অর্জন, তার মধ্যে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ ও ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুক-২০১৩ অনুযায়ী, ২০০০-২০১০ সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে, বৃদ্ধির হার ৫। একই সময়ে সবজির মোট উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক হারের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের ‘খাদ্যশস্য: বিশ্ববাজার ও বাণিজ্য-২০২১’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চাল আমদানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) হিসাবে, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বর্তমানে চতুর্থ বাংলাদেশ। ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। আম উৎপাদনে সপ্তম। পুরোনো জাতের হলেও মোট আলু উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য বিস্ময়কর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশ আলু উৎপাদনে রয়েছে অষ্টম স্থানে। পাশাপাশি পাট উৎপাদনে দেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
এশীয় ফসলের জাত উদ্ভাবনেও ভালো করছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশে সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বিনা। ২০১৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন আমাদের কৃষি গবেষকেরা। প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রশংসনীয়।

অর্থনীতিতে দেশজ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ শীর্ষে এসেছে।

অর্থনীতিতে দেশজ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ শীর্ষে এসেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে (রিয়েল জিডিপি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিশ্বে ষষ্ঠ স্থান নিয়েছিল বাংলাদেশ। [সূত্র-ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক ডেটাবেইস, আইএমএফ, এপ্রিল ২০২০।] তবে তালিকার শীর্ষ দশটি স্থানে কয়েকটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশও রয়েছে। যেমন দক্ষিণ সুদান, রুয়ান্ডা, লিবিয়া, ডোমিনিকা, ইথিওপিয়া, বাংলাদেশ, আর্মেনিয়া, তাজিকিস্তান, জিবুতি, নেপাল।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ-২০২১ মতে, পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয়, ২০২০ পর্যন্ত ছিল দ্বিতীয়। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম-নবম স্থানে। উল্লেখযোগ্য দুটি অবস্থান হচ্ছে, জনশক্তি রপ্তানি ও আউটসোর্সিং। উভয় খাতেই দেশের অবস্থান অষ্টম। জাহাজভাঙা শিল্পে বিশ্বে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

কিছু আন্তর্জাতিক সূচকে ভালো করলেও সামগ্রিকভাবে অপরাপর বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তেমন সুখকর নয়। জাতিসংঘের উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপি ২০১৭ সাল থেকে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক প্রকাশ করে আসছে৷ প্রাক্‌–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, অর্থনীতি আর পরিবেশ—এই সাতটি প্রধান বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে মোট ১৯৯টি সূচকের মাধ্যমে ১৩৮টি দেশের মধ্যে র‌্যাঙ্কিং করা হয়৷ গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স–২০২০–এ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে ভারত (৭৫) ও তলানিতে বাংলাদেশ (১১২)। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ৮৭, ভুটান ৯৪, নেপাল ১১০ ও পাকিস্তান ১১১। বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনে, যেখানে স্কোর ১০০–তে মাত্র ১৬ দশমিক ৪৷ আর উচ্চশিক্ষায় ২৪ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে গোটা বিশ্বের মধ্যে অবস্থান ১২৯৷ অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিচে আছে বিশ্বের মাত্র নয়টি দেশ।

বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নেই, হচ্ছে ধারাবাহিক অবনতি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের ১ হাজার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। ২০১২ সালেও ৬০১তম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এদিকে বিশ্বে পাসপোর্টের মান নির্ধারণকারী সূচক ‘হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স-২০২১’ সূচকের মোট ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৮তম স্থানে রয়েছে। ২০০৭ সালের ৬৮তম অবস্থান থেকে ক্রমাগত পাসপোর্ট মান দুর্বল হচ্ছে। ক্রমাবনতি আরেকটি বৈশ্বিক সূচকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসা সহজীকরণ ইনডেক্স ২ অঙ্কের ঘরে ছিল (৯৯), যা ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুর্বল হতে হতে ১৭৮–এ পৌঁছে। সর্বশেষ ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮।

প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৫২ জন জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ; প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় প্রায় তিন গুণ ঘন। ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। মানব উন্নয়ন সূচকে দেখানো হয় যে বাংলাদেশিদের ২৪ দশমিক ১ শতাংশ অর্থাৎ, প্রায় ৪ কোটি মানুষ ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের’ মধ্যে জীবন যাপন করছেন, করোনাকালে যা বেড়েছে অন্তত ৩ শতাংশ। সবচেয়ে গরিব ৪০ শতাংশের আয় মোট আয়ের মাত্র ২১ শতাংশ, সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয় মোট আয়ের প্রায় ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশের গিনি সূচকে শূন্য দশমিক ৪৭৮। কোনো দেশের এই স্কোর দশমিক ৫০–এর ঘর পেরোলেই উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে ধরা হয়। মানব উন্নয়ন সূচক ২০২০ মতে, বাংলাদেশের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্মনিবন্ধন হার মাত্র ২০। এতে ডিজিটাল ডেটাবেইসকেন্দ্রিক সেবা প্রদানের প্রস্তুতিহীনতা ফুটে ওঠে। মোট শ্রমশক্তির ৫৫ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। অতিগরিব মানুষের সংখ্যায় পঞ্চম হলেও ওয়েলথ-এক্সের ‘আ ডিকেড অব ওয়েলথ’ গবেষণায় এক দশকে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ) বিশ্বের সব বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষ অবস্থানে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০২০-২১-এ জানানো হয়, এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরিতে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্যসীমার নিচে। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ছিল গড়ে ৪৮ ডলার। (তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা প্রায় ১০০ ডলার মজুরি পান)।

২০২১ সালের বৈশ্বিক শান্তি সূচক (জিপিআই) অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৯১তম স্থানে। তবে বিশ্বের ১৬১টি দেশ ও অঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, স্ত্রী নির্যাতনের হারে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। বাল্যবিবাহে বাংলাদেশ চতুর্থ। ইভ টিজিংয়ের শিকার ২৮ শতাংশ। তবে করোনাকালে দেশে ২৩ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন (বিশ্বে ১৬তম)। যৌন সহিংসতায় ঢাকা বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারী দেশের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিষণ্নতায় ভোগেন ৭১ শতাংশ ঢাকা অধিবাসী, বৈশ্বিক হিসাবে যা অন্যতম শীর্ষে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ডব্লিউইএফ সামাজিক উত্তরণ সূচক-২০২০ মতে, বাংলাদেশ ৮২টি দেশের মধ্যে ৭৮তম, অর্থাৎ সুষম উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনো তলানির সারির একটি দেশ বাংলাদেশ। উপসূচকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জীবনভর শিক্ষার সুযোগে। উপসূচকটিতে ৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮২তম। দেশের ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। ৫১ শতাংশ শিশু অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ২০১৬ মতে, মারাত্মক অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তালিকাতেও বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের শিশুরা তার সম্ভাবনার মাত্র অর্ধেক কাজে লাগাতে পারে।

চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ১ কোটি ১৪ লাখের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের মধ্যে শুধু পূর্ব তিমুরের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। বাংলাদেশ সরকার জিডিপির মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্য খাতে, যা বৈশ্বিক তলানিতে।

জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্কের এসডিজি সূচক ও ড্যাশবোর্ডস রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী, ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১১তম ছিল। পরিবেশ–অবান্ধব এমডিজির ৮টি লক্ষ্য সফলভাবে পূরণ করলেও প্রকাশিত এসডিজি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৮টিতেই ‘লাল কার্ড’ ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ১ কোটি ১৪ লাখের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের মধ্যে শুধু পূর্ব তিমুরের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। বাংলাদেশ সরকার জিডিপির মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্য খাতে, যা বৈশ্বিক তলানিতে। চিকিৎসাসহ স্বাস্থ্যসেবা খাতে যত খরচ হয়, তার ৬৯ শতাংশ যায় ব্যক্তির পকেট থেকে। বাকি ৩১ শতাংশ খরচ করে সরকার, এনজিও ও দাতা সংস্থা। এদিকে ক্ষুধা বা ‘হাঙ্গার ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশ বিশ্বে ১০৩তম।

এফএও’র ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফরেস্ট-২০১৬’ প্রতিবেদনে মতে, ২৫ বছরে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি কমেছে। এর ২০১০-১৫ পাঁচ বছরেই কমেছে ১৩ হাজার হেক্টর। বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে ১৭টি দেশের কৃষিজমি ও বনভূমি দুই-ই কমেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের নাম শীর্ষে! বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি, যা ২৫ শতাংশ হওয়া আদর্শ। পরিবেশদূষণে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯! গত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা শীর্ষ তিনে অবস্থান করে দিল্লি ও করাচিকে পেছনে ফেলে এ বছর শীর্ষে পৌঁছেছে। এক যুগে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে। আইকিউএয়ারের বায়ুমান সূচক অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ দূষিত ১০০ শহরের মধ্যে বাংলাদেশের ৪টি।

২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের কোয়ালিটি অব রোডস সূচকে ভারত ছিল ৮২ নম্বরে, বাংলাদেশ ৮৩–তে। ২০১৯ সালে ভারত উঠে এসেছে ৫৫ নম্বরে, কিন্তু একই সময়ে কিলোমিটার প্রতি রাস্তায় বিশ্ব রেকর্ড পরিমাণে খরচ করেও অবনমন হতে হতে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১০৭-এ। কিলোমিটার প্রতি রাস্তায় বাংলাদেশ ভারতের প্রায় নয় গুণ, ইউরোপের তিন গুণ। ১০ বছরে রাস্তায় ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও বাংলাদেশে চার লেনের সড়কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০০ কিলোমিটার।

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভঅ্যাবিলিটি ইনডেক্স ২০১৯ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ও নাইজেরিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী লাগোসের ঠিক পরেই ঢাকাকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বনিম্ন বাসযোগ্য শহর হিসেবে স্থান দিয়েছে। ১৪০টি মেগাসিটির মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৮তম। ট্র্যাফিক জ্যামের শিকার ৯১ শতাংশ মানুষ।

ইন্টারনেটের গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলার ‘স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’র মতে, বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ নম্বরে (জুন ২০২১)। পেছনে রয়েছে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং বাণিজ্য-নিষেধাজ্ঞায় দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ভেনেজুয়েলা। যে উগান্ডাকে নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ট্রল করি, তারাও আমাদের চেয়ে আট ধাপ এগিয়ে। বিশ্বের প্রধান সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক প্রকাশিত ‘ডিজিটাল কোয়ালিটি অব লাইফ ইনডেক্স ২০২১’ ডিজিটাল জীবনযাত্রার সূচকে ১১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৩তম।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ‘রুল অব ল ইনডেক্স’ সূচককে আইনের শাসনের ওপর প্রকৃত তথ্যের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালের প্রকাশিত সূচকের সামগ্রিক ‘আইনের শাসনে’ ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ আর মধ্য আয়ের ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২২তম। শুধু ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার’ এই উপাদানটির বিচারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে! এদিকে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪তম। তবে ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ (ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবস্থান না বলাই বরং শ্রেয়!

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর’ গ্রন্থের রচয়িতা। faiz.taiyeb@gmail.com