অভিবাসন

আদম ও পুঁজি পাচারকারীরা কেন পার পাবে?

ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারকৃত অভিবাসী
ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারকৃত অভিবাসী

১০ মে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় তিউনিসিয়ার কাছাকাছি নৌকাডুবিতে ৩৯ জন বাংলাদেশি মারা গেছে; ১৪ জন বাংলাদেশিকে ডুবন্ত নৌকা থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। পাচারকারীরা লিবিয়া থেকে যাত্রা করে বড় একটি নৌকা থেকে তাদের আরেকটি ছোট নৌকায় গাদাগাদি করে তুলে রওনা দেওয়ার পর অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে নৌকাটি ডুবে যায়।

২০১৯ সালের শুরু থেকে ১০ মের মধ্যেই এ রকম নৌকাডুবির শিকার হয়ে ভূমধ্যসাগরে ১৭৫ জন ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে; তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি নাগরিক। ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, হংকং, এমনকি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে জীবন বাজি রেখে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার জন্য হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ মানব পাচারকারী চক্রগুলোর হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিচ্ছে।

অনেক দিন ধরেই বিশ্বব্যাপী মানব পাচার সিন্ডিকেটগুলোর বড় খদ্দের বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণেরা। এটা গবেষকদের কাছে পুরোনো খবর। বাংলাদেশের রাজধানী থেকে শহর-বন্দর-গঞ্জ-গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে আদম ব্যাপারী চক্রগুলোর মাঠপর্যায়ের দালালেরা, যাদের ফাঁদে
ধরা পড়ছে সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলা তরুণেরা। একজন তরুণকে ৮-১০ লাখ টাকা খরচ করতে হয় ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায়। এ জন্য পরিবারের শেষ সম্বল জমিটুকু হয়তো বিক্রয় হয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরছে, নয়তো সাগর-মহাসাগরে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা মরুভূমিতে ও জঙ্গলে মারা পড়ছে। পরিবারগুলো নাম লেখাচ্ছে নিঃস্ব-ভূমিহীনদের তালিকায়।

কিছুদিন পরপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সাগর-উপসাগরে ভাসমান ‘বোট-পিপলের’ কাহিনি কিংবা সাগর-উপকূলের জঙ্গলে আবিষ্কৃত গণকবর ও অবৈধ বন্দীশিবির বিশ্বের জনগণের বিবেকে নাড়া দিয়ে চলেছে। সেগুলো হয়তো বাংলাদেশের কয়েক শ অভিবাসনপ্রত্যাশীর ব্যর্থ অভিযানের শেষ গন্তব্য। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে শত শত গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রগুলোর নৃশংস খুন-জখম, জঙ্গলে যত্রতত্র লাশ পুঁতে ফেলা বা সাগরে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া এবং অভিবাসীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের জীবিকার জন্য এই প্রাণান্তকর সংগ্রামকে পুঁজি করে মানব পাচারকারীরা যে অমানবিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে, ‘দাস ব্যবসা’র মতো তার বীভত্স রূপ উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের তরুণদের প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব থেকে সৃষ্ট মরিয়া অভিবাসন–প্রয়াসও বটে।

বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৮ লাখ কর্মপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছে, অথচ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ৮ থেকে ১০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। তাহলে বাকি ৮-১০ লাখের জন্য কী ব্যবস্থা? জীবনের শেষ সম্বল বিক্রি করে এরাই মরিয়া হয়ে আদম ব্যাপারীদের কাছে ধরনা দিচ্ছে নিজেদের ও পরিবারকে বাঁচানোর আশায়। বৈধ পথে বিদেশে অভিবাসী শ্রমিক-পেশাজীবী হিসেবে যেতে পারছে প্রতিবছর ৬ থেকে ৭ লাখ। এখনো একজন বাংলাদেশি অভিবাসীর বিদেশে যেতে অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের তুলনায় চার-পাঁচ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

২০ মে প্রথম আলোয় কোন দেশে যেতে কত টাকা লাগছে, তার গবেষণালব্ধ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। ওই বিবরণ মোতাবেক, জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সির দালাল ধরে বিদেশে যেতে বাংলাদেশিদের গড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। মালয়েশিয়া যেতে খরচ পড়ছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সৌদি আরবে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। অথচ শ্রীলঙ্কার একজন অভিবাসীকে কুয়েতে যেতে খরচ করতে হচ্ছে মাত্র সাড়ে ২৭ হাজার টাকার সমপরিমাণ অর্থ। মধ্যপ্রাচ্যে যেতে ভারত, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার তরুণদের খরচ পড়ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ টাকার নিচে। চার-পাঁচ গুণ বেশি খরচ করা অভিবাসনেচ্ছু তরুণদের শোষণ-বঞ্চনা নিরসনে সরকারের কি কোনো দায়িত্ব নেই?

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর প্রচ্ছন্ন বেকার তরুণদের সাধনা হলো, যেভাবেই হোক বিদেশে পাড়ি দিতে হবে। গত কয়েক বছর দেশের জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যায়নি। তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ৮ শতাংশ অতিক্রম করলেও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তেমন গতি সঞ্চার করা যায়নি। অন্যদিকে বর্তমান সরকার অভিবাসনের ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে সরাসরি ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যক্তি খাতের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দৌরাত্ম্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের লাখ লাখ বৈধ-অবৈধ অভিবাসীর প্রতিবছর পাঠানো ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার (২০১৮ সালে ১ হাজার ৫৪২ কোটি ডলার) এবং অনানুষ্ঠঅনিক চ্যানেলের রেমিট্যান্স এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে পাঠানো আরও ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ হয়তো অভিবাসীদের পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায়। এই অর্থ কি আমাদের অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করছে না? বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ এখনো তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলে খোদ অর্থমন্ত্রী যে দাবি করেছেন, তার জন্য এই ২৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ কী বিপুল অবদান রাখছে, তা কি আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করছি? প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের কার্যকর বিকল্প হলো এই ২৫ বিলিয়ন ডলার।

মানি লন্ডারিংয়ে নিয়োজিত দুর্নীতিবাজ আমলা, পুঁজি লুটেরা ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক, হুন্ডি পদ্ধতির সহায়তায় পুঁজি পাচারকারী ঋণখেলাপি ও লোভাতুর আদম ব্যাপারীরা মানসিকভাবে অসুস্থ বলে আমার মনে হয়। আমি একাধিক কলামে বলেছি, কীভাবে রেমিট্যান্সের ফরমাল চ্যানেলগুলো অপব্যবহৃত হয়ে চলেছে মানি লন্ডারিং বা কালোটাকা বৈধকরণের প্রক্রিয়ায়। দেশের দুর্নীতিবাজ আমলারা তাদের দুর্নীতিজাত অর্থ পরিবারের অভিবাসী সদস্য বা আত্মীয়দের ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হুন্ডি পদ্ধতিতে অতি সহজে বৈধ রেমিট্যান্সে রূপান্তরিত করে চলেছে, এ খবর কি আমাদের নীতিপ্রণেতারা জানেন না? বিদেশে অবস্থানকারী একজন বাংলাদেশি তার প্রবাসের কর্মস্থলে কী কাজ করছে বা আদৌ উপার্জনশীল কিছু করছে কি না, তা জানার কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই। কিন্তু প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক প্রবাসীর যেহেতু ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ রয়েছে, তাই ওই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যত অর্থই দেশে প্রেরিত হোক, সেগুলো গ্রহণ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।

২০০২ সালে এ দেশে ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’ পাস হয়েছে; ২০০৯ সালে ও ২০১২ সালে তা সংশোধনও করা হয়েছে। এই আইনে ‘নো ইয়োর ক্লায়েন্ট’ এবং ‘সাসপিশাস ট্রানজেকশন রিপোর্ট’ চালু করা হলেও বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্স নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি এখনো ব্যাংকগুলো করতে চায় না। প্রকৃতপক্ষে যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর বৈধ রেমিট্যান্স আসছে, তার একটা অংশ দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট দুর্নীতিজাত কালোটাকা, যা প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের সহায়তায় হুন্ডি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রং বদলে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। এমনিভাবে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিবাজেরা ও ব্যাংকঋণ লুটেরারা অর্থ পাচার করছে বিদেশে, গড়ে উঠছে টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’ ও মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৯০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি ঘোষণা করেছে কয়েক বছর আগেই। এই পুঁজি পাচারকারী ও আদম ব্যাপারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে দেশের কল্যাণ হবে।

ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক