ইদানীং রাজনীতি

আদনান হত্যা এবং নতুন বাস্তবতার সূচনালগ্ন

.

এই লেখা থাকবে হতাশায় ভরা। নিজ দায়িত্বে পড়বেন। পাঠক সরকারদলীয় হলে ভীষণ গালমন্দ করবেন। তাও লিখছি।
ঢাকার উত্তরার কিশোর আদনানকে হত্যা করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি প্রথম আলোতে রিপোর্ট আছে ‘গ্যাং কালচারের’ নামে ভয়ংকর হয়ে উঠছে যে কিশোররা। রিপোর্টে আছে নাইন স্টার আর ডিসকো বয়েজ নামের দুটি ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের কথা। গ্যাংয়ের সদস্যরা মূলত কিশোর। মোটরসাইকেল রেস করে, দল বেঁধে মোটরসাইকেল চালিয়ে ভয় দেখায়, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, দাপট দেখায় ইত্যাদি। এসব থেকে স্বাভাবিকভাবেই মারামারি। প্রথমে ছোটখাটো, তারপর ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর। ভয়ংকর পর্যায়ের অশুভ সূচনা আদনানের হত্যার মধ্য দিয়ে।

২.
২০১৪-র বড়দিনের আগে (ডিসেম্বরের ২০-২২ তারিখের দিকে) বিবিসি রেডিওতে খবর শুনছিলাম মেক্সিকো সরকারের সতর্কবাণী। আমাদের ঈদের মতো ওসব দেশে বড়দিনের ছুটিতে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ ‘নাড়ির টানে দেশে যায়’। বহু মেক্সিকান আমেরিকায় কাজ করে। বড়দিনের ছুটিতে তারা দেশে আসে। আমাদের ঈদের বাস-ট্রেনের পরিবর্তে তারা নিজে গাড়ি চালিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো যায়। নিজের গাড়ি চড়ে যাওয়াই যুক্তরাষ্ট্রের ‘মেইন কালচার’।
বিবিসিতে শুনেছিলাম মেক্সিকো সরকার তার নাগরিকদের জন্য সতর্কবাণী দিচ্ছে—ভাইসব, আপনারা একা গাড়িতে চড়ে আসবেন না। দশ-বিশটা গাড়ির কাফেলা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজ দেশে আসবেন। দয়া করে রাতে গাড়ি চালাবেন না। মেক্সিকো সীমান্তে দিনের আলোতে প্রবেশ করবেন। রাতে হাইওয়ে ব্যবহার করবেন না। হাইওয়ের নির্জন জায়গায় গাড়ি থামাবেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোদ্দা কথা, হাইওয়েতে যেসব ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের ‘আধিপত্য’, তাদের বিরুদ্ধে সরকার প্রায় অসহায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড়দিন দেশে কাটাতে আসা নাগরিকেরা যাতে পথে ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের খপ্পরে না পড়ে, তাই দলবদ্ধ হয়ে আসার উপদেশ। রাতে চলাচলের মতো বোকামি না করার নির্দেশ।
আর এই সপ্তাহেই সেই বিবিসিতেই শুনলাম, মেক্সিকোর কোনো এক ‘ট্যুরিস্ট’ শহরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের মারামারির ফলে এক গ্যাং অন্য গ্যাংয়ের সাতজনের (দু-একজন কমবেশি হতে পারে, মনে নেই) কল্লা কেটে কাটা মুণ্ডুগুলো গাড়ির ছাদে লাইন করে সাজিয়ে রেখেছিল, সবাই যাতে দেখতে পায়।
আফ্রিকার এক দেশের খবর। পুলিশের সোর্স খবর দেয়—স্যার, আজ অমুক এলাকায় ব্যাংক ডাকাতি হবে। ডাকাতদের মেশিনগান থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ ওই এলাকার ধারে-পাশে যায় না। কী ঠেকা পড়েছে বেঘোরে প্রাণ দেওয়ার। পুলিশ জানতেও চায় না।
উত্তরায় তা-ই হচ্ছে। পুলিশ বলে, কী গ্যাং? ছোটখাটো দুই-চারটা মারামারি হয়েছে।
দুনিয়াতে অবশ্য অন্য চিত্রও আছে। ২০১৬ সালে জাপানে বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়েছে এক ব্যক্তি। জি, সারা দেশে সারা বছরে একজন। সূত্র সেই বিবিসিই।
পাঠক, ভুল বুঝবেন না। শুধু একটা দেশ, অর্থাৎ মেক্সিকোকে অপবাদ দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। লাতিন আমেরিকার বহু দেশ—এল সালভাদর, গুয়াতেমালা ইত্যাদির চিত্র একই গোছের। ক্রিমিনাল গ্যাংগুলোর প্রতাপ-প্রতিপত্তি মহান।

৩.
আমাদেরও প্রায়ই খবর আসে—প্রভাব বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ। আহত ৫, নিহত ১ ইত্যাদি। আগে হতো ছাত্রদলের অমুক-তমুক গ্রুপের সংঘর্ষ। কারণ ও ফলাফল একই কিসিমের।
অর্থাৎ ক্রিমিনাল গ্যাংগুলোর মারামারি-হানাহানিতে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ না বলে অপরাধ চক্র বা ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের দুই অংশ বলাই বরং বাস্তবসম্মত।
বলা বাহুল্য, উত্তরায় যে কিশোরেরা দল বেঁধে মোটরসাইকেল চালায়, তারা সবাই যেমন ক্রিমিনাল না, তেমনি ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের সবাই আধিপত্য বিস্তারে মত্ত নয়। যারা মত্ত, তাদের তা-ই বলা উচিত।
ইস্কাপনকে ইস্কাপনই বলতে হবে। রুইতন, হরতন বলে সমস্যা এড়িয়ে গেলে ক্ষতি হবে সবারই।

৪.
ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের আবির্ভাব হয়ে গেছে। প্রতাপ এখন বাড়বেই। গতি কী হবে, সেটাই একমাত্র অজানা বিষয়। তবে গতি সঞ্চার হবে সম্ভবত দ্রুতভাবেই।
কারণ দুটো—যেসব দেশে জেএমবির মতো ক্রিমিনাল গ্যাংগুলো অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে, সেসব দেশে গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে দুটো ব্যাপার ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল এবং রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সংকীর্ণ স্বার্থ বিবেচনায় ‘নিজের লোক’-এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলছি, লিখছি কমবেশি এক যুগ ধরে। একই কথা বা লেখার পুনরাবৃত্তি করেছি। লাভ বেশি হয়নি। অবশ্য বেগম খালেদা জিয়া ইদানীং একাধিকবার র্যা বের বিলুপ্তি চেয়েছেন, যদিও ক্ষমতায় থাকাকালীন ছিলেন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বেচারা লুৎফুজ্জামান বাবর, এখন তো ডান্ডাবেড়িসহ প্রিজনভ্যানে বা পাশে তাঁর শুধু ওই গোছেরই ছবি দেখা যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন ক্রমাগতভাবে বেআইনি এবং নৃশংস অপরাধমূলক (ঠান্ডা মাথায় হত্যা) কাজ করতে থাকে, তখন আস্তে আস্তে সমাজের অন্য সব প্রতিষ্ঠানই অকেজো হয়ে পড়ে, ভেঙে যায়। ফলাফল, সমাজটা চলে যায় অপরাধীর নিয়ন্ত্রণে। সরকার, রাজনৈতিক দল, মহল্লা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—সবাই হয়ে পড়ে অসহায়। অপরাধই হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রক। অপরাধে জড়িত হওয়া লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সপ্তাহ দুয়েক আগের এক রিপোর্টে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেন হয় ৩ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা।

৫.
আদনানের মা-বাবা, নিকটাত্মীয়দের জানাচ্ছি সমবেদনা। খুনিদের ধরা হবে, বিচার হবে আর বিচারের শেষে শাস্তি হবে—বুকে হাত দিয়ে এই সান্ত্বনার কথা বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।
এ নিয়ে উত্তরায় একটা ‘ক্রসফায়ার’ হলে অবাক হব না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলবে, আদনানের খুনি বলে তদন্তে চিহ্নিত ব্যক্তিটিকে ধরতে গেলে সে গুলি ছোড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টা গুলিতে সে নিহত হয়।
কোনো দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, ভীষণভাবে তখন তারাই প্রথম প্রথম ক্রিমিনাল গ্যাংকে আশকারা দেয়। ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের ‘আয়ে’ ভাগ বসানোর জন্য। আমাদের দেশে যা শুরু হয়েছে, এখানেও শেষ পর্যন্ত হয়তো তা-ই হবে।
দেশ এক যুগ ধরে যেভাবে চলছে, নিকট ভবিষ্যতে তার বিশেষ কোনো হেরফের হবে না। তাই আদনানের মতো পরিণতি যাতে আর কোনো কিশোর–তরুণের না হয়, সে রকম কিছু আশা হয়তো আমরা করতেই পারি। তবে হায়, সে আশায় ভরসা নেই।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট। আইনের শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।