আগস্ট, ২০১৪ সালে কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সির আত্মহত্যার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে দুটি উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট বা মতামত প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়। কিন্তু আত্মহত্যার ওপর দরকারি আলোচনার পরও এ নিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় একেবারেই উপেক্ষিত হয়েছে দুটো লেখায়। সেই বিষয়গুলো শুধু বাংলাদেশের পত্রিকায় আলোচিত হয়নি তা নয়, বরং বিশ্বের চিকিৎসক সমাজ তথা সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যেও প্রায় উপেক্ষিত থেকেছে অনেক দিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে; অর্থাৎ প্রায় প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একজন মানুষ বেছে নেয় আত্মহননের পথ। বাংলাদেশে ২০১১ সালের হিসাবে ১৯ হাজার ৬৯৭ জন আত্মহত্যা করেছে। অন্য একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০০২ থেকে ২০০৯ মোট ৭৩ হাজার ৩৮৯ জন আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে, যাদের বেশির ভাগই অল্প বয়সী এবং প্রায় ৮৯ শতাংশ নারী।
আত্মহত্যা মানুষ কেন করে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। আশির দশক পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করতেন, গভীর বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগ, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাই-পোলার, মুড ডিজর্ডার ইত্যাদির সঙ্গেই শুধু আত্মহত্যা জড়িত। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০ শতাংশ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কোনো রকমের মানসিক রোগ জড়িত ছিল না। শুধু তা-ই নয়, আত্মহত্যার রোগীদের মস্তিষ্কের গঠন এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক পদার্থ এগুলোর মধ্যেও পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে একজন সাধারণ সুস্থ মানুষের তুলনায়। বিজ্ঞানীরা আরও খুঁজে পেয়েছেন জিনেটিক বা বংশগতির সূত্র। প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই বংশগতির বা জিনেটিকের যোগসূত্র একেবারে প্রমাণিত। সেই সঙ্গে সামাজিক, পরিবেশগত কারণ এবং অন্যান্য ঝুঁকি মিলিয়ে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান একটি রোগের কারণগুলোকে একেবারে ছেঁকে আলাদা করে তুলে নিয়ে আসতে পারে, আর এই বিদ্যাকে বলে ‘এপিডেমিওলজি’। এই বিদ্যায় দেখা যায় একটি রোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘মাল্টিফ্যাক্টরিয়াল’ বা ‘বহুমুখীন কার্যকারণে’ যুক্ত। আমি বিষয়টি ডায়াবেটিসের সঙ্গে তুলনা করি, যাতে সবাই সহজে বুঝতে পারে। কারও যদি বংশে ডায়াবেটিস থাকে, সেই সঙ্গে ওই ব্যক্তি শারীরিক পরিশ্রম না করে বেশি বেশি শর্করাজাতীয় খাবার খায়, অতিরিক্ত ওজন অর্জন করে, তাহলে তার ডায়াবেটিস হবে। কিন্তু এগুলো অনেকখানি প্রতিরোধ করা যায় এবং ডায়াবেটিসকে অনেক দিন আটকে রাখা যায়। তাহলে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে তা হবে না কেন? এ ক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হলো আত্মহত্যাকে এখন পর্যন্ত কেউ ডায়াবেটিসের মতো রোগ হিসেবে দেখছে না। এ জন্যই চিকিৎসকেরা, বিশেষ করে আমেরিকার মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞরা ‘আত্মহত্যা’ বা ‘আত্মহত্যার প্রবণতা’কে একটি রোগ হিসেবে ‘ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়েল অব মেন্টাল ডিজর্ডারস’-এর পঞ্চম ভার্সনে (ডিএসএন-৫) রোগ হিসেবে বিবেচনার সুপারিশ করেছেন। এই সুপারিশ কার্যকর হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এবার আসছি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যা নিয়ে সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং প্রাচীন একটি আইনের বিষয় নিয়ে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আত্মহত্যা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আসলে খোদ ইংল্যান্ডেও ১৯৬১ সালের আগে আত্মহত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে যে ‘পেনাল কোড’ (১৮৬০) গ্রহণ করে, তা মূলত সেই ব্রিটিশ আমলের আইনের অপভ্রংশ। যদিও ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশে কাউকে আত্মহত্যার চেষ্টার জন্য সাজা দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই; তার পরও এই আইনের সংশোধন অবিলম্বে প্রয়োজন; কারণ এর সামাজিক প্রভাব অনেক ব্যাপক। আমরা কি একজন ডায়াবেটিসের রোগীকে ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য বা অন্য কোনো রোগীকে উল্টো আইনসংগত সাজা দিই? অবশ্যই না। সে ক্ষেত্রে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার প্রবণতাকে একটি রোগের মতো আমলে নিতে যেখানে বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একযোগে উপদেশ দিচ্ছেন, সেখানে আমরা কেন তা গ্রহণ করব না? তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশ কেন এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে? আমরাও দেখতে চাই বাংলাদেশে এ রকম কোনো অমানবিক এবং অযৌক্তিক আইন নেই!
আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত। একাধারে মানসিক রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। কারও জ্বর হলেই যেমন প্যারাসিটামল খেতে হয়, তেমনি বিষণ্নতা বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজনে ওষুধ নেওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবেশগত কারণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সমাজে নারীরা অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং অনেক ক্ষেত্রে অসহায়। তাদের যেকোনো পরিস্থিতিতে ‘স্টিগমা’ নিয়ে বিচার না করা, সামাজিকভাবে ভিকটিমকে গ্রহণ করা, সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়া থেকে আড়ালে রাখা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করা যে ‘আত্মহত্যা একটি অসুখ, যা ঠেকানো সম্ভব এবং আমরা সব সময় তোমাদের পাশে আছি’, এই জাতীয় শক্তিশালী মেসেজ দেওয়া অনিবার্য। সেই মান্ধাতার আমলের আইনকে উৎখাত করে এবং দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতাকে রোগ হিসেবে নিয়ে এই মহান পদক্ষেপটি নিতে পারে বর্তমান সরকার।
ব্রিটিশ কবি থমাস শ্যাটারটন আত্মহত্যা করেছিলেন এই বলে যে ‘আমার মতো কোমল হৃদয়ের জন্য এই নির্মম পৃথিবী যোগ্য নয়।’ কেউ পৃথিবীর অযোগ্যতা, কেউ দেশের অযোগ্যতা, কেউ পরিবারের অযোগ্যতা, কেউ বা ব্যক্তির অযোগ্যতাকে অজুহাত করে এই আত্মহননের পথে যেতে পারে। আমাদের উচিত সামাজিকভাবে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বাড়িয়ে দেওয়া, বন্ধুত্ব বাড়িয়ে দেওয়া, ভালোবাসা বাড়িয়ে দেওয়া। সামাজিকভাবে আমরা যেন কোনো অজুহাত সৃষ্টি করে না দিই; কারণ জীবন বড় মূল্যবান সম্পদ, জীবন একটাই। এই জীবন থমাস শ্যাটারটনের কবিতার মতো রোমান্টিক হোক, তাঁর জীবনের মতো যেন অকালে, অকারণে ঝরে না যায়; এই হোক আমাদের সামাজিক অঙ্গীকার!!
সেজান মাহমুদ: চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও লেখক। ফ্লোরিডা এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক।