আত্মহত্যা ‘মহামারি’ হয়ে উঠছে কেন

অলংকরণ: আরাফাত করিম

পঁচিশ বছর আগের কথা। আমার তখন কিশোর বয়স। সে সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন সালমান শাহ। হঠাৎ একদিন তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলো। জানা গেল তিনি আত্মহত্যা করেছেন। সে খবর পত্রিকায় পড়ার পর বেশ কয়েকজন কিশোর-কিশোরী প্রিয় অভিনেতার মৃত্যুতে শোক সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। সে ঘটনায় সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, তার রেশ কাটতে অনেক সময় লেগেছে।

সে সময়ে আত্মহত্যার বেশির ভাগ ঘটনা বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, সংসারে অশান্তি বা পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বেশি ঘটত। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতার দায়ভার থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আত্মহত্যার কারণ ও সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, এখন এই বিষয়কে যে কেউ মহামারির সঙ্গে তুলনা করে বসতে পারে। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যায় প্ররোচনার কারণে বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি তার সমস্যার প্রভাব থেকে পরিবারকে বাঁচানোর জন্য সমাজের প্রচলিত ধারণার বিপরীতে যাওয়ার একমাত্র উপায় হিসেবে আত্মাহুতিকে বেছে নিচ্ছেন।

আমাদের পরিচিত পরিমণ্ডলে আত্মহত্যার ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে। গণমাধ্যমে যতটুকু আসছে, বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। এর অন্যতম কারণ, লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার ঘটনা অনেক সময় পরিবার প্রকাশ করতে চায় না। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পরিবার এটিও আশঙ্কা করে, আত্মহত্যার খবর প্রকাশ হলে পরিবারের প্রতি পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাকালে আত্মহত্যা বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের মতে, এই সংখ্যা ৪৫ শতাংশ। মোট আত্মহত্যাকারীর ৮৩ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০২২)। আমাদের পাশের দেশ ভারতের চিত্র এ ক্ষেত্রে আরও ভয়ানক।

ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৫৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। গড়ে দৈনিক এক থেকে দুজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বেকারত্ব।

পরীক্ষায় পাস আর পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান যুবসমাজের সামনে হাতছানি দেয় অজানা আশঙ্কা আর চরম হতাশা। এ জন্য তারা আত্মহত্যাকে সমস্যা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হিসেবে ভাবার কারণে জীবনের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে আত্মবিশ্বাস নেতিবাচক হয়ে যায়। এ কারণে বেঁচে থাকাকে আর অর্থবহ মনে হয় না। তার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ ও আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার হতাশায় আক্রান্ত থাকে। তাই নেতিবাচক চিন্তার প্রাধান্য থেকে মুক্তি পায় না তারা। এ জন্য নেতিবাচক আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

আত্মহত্যার হাজার কারণ থাকতে পারে, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য ‘আত্মবিশ্বাস’—এই একটি শব্দই যথেষ্ট। সমস্যা আসবেই, কিন্তু তা সমাধান করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা শুধু মানুষকেই দিয়েছেন। ইতিবাচক মূল্যবোধ চর্চার কোনো বিকল্প নেই, যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া, ধর্মীয় চেতনাবোধ, সত্যচর্চার মানসিকতা, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, গুণগত সময় ব্যয় করা হতে পারে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি গণমাধ্যমে আত্মহত্যার খবর ফলাও করে প্রচার করার বিষয়ে আরও সচেতনতার প্রয়োজন।

পাঠ্যবইয়ে লেখা বাক্যগুলো: যেমন ‘গুরুজনকে সম্মান করো’, ‘ছোটদের স্নেহ করো’, ‘ক্ষমা একটি মহৎ গুণ’, ‘অন্নহীনে অন্ন দাও’, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ প্রভৃতি বাণী আজ শুধু ট্রাকের পেছনে দেখা যায়। নীতিবাক্য ধারণ করার জন্য সুস্থ বিনোদনচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আগেকার দিনের মতো পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব, লাইব্রেরি গঠন করার উদ্যোগ নীতিহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। পাশাপাশি সন্তান বাবা-মায়ের জীবনে আশীর্বাদ—এ কথা সন্তানকে বোঝানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের। সন্তানকে ভালো কাজে উৎসাহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বাড়ানো, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন।

সমাজ একদিনে পরিবর্তন হবে না। কিন্তু পরিবার থেকে যদি ভালোবাসার বীজ বপন না করা যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সফলতা প্রত্যাশা করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়মাত্র।

পরিশেষে বলতে চাই, আত্মহত্যা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যার সমাধান মানবেরই হাতে। জীবন সুন্দর, আর বেঁচে থাকাটা আশীর্বাদ। যার মৃত্যু যখন হওয়ার তখনই হবে। তাই জীবনে যত কষ্টই আসুক, মনে রাখা দরকার, তা কখনোই জীবনের থেকে বড় হতে পারে না। সময়ে সব সমস্যাই ম্লান হয়ে যায়। শুধু দরকার ধৈর্য ধরে তা মোকাবিলা করার। তাই সমস্যাকে নয়, আমাদের উচিত বেঁচে থাকাকে গুরুত্ব দেওয়া। কারও জীবনের বিকল্প কিছু নেই।

তামান্না তাসকীন সহকারী অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ও পিএইচডি গবেষক।