পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য যদি হয় কংগ্রেস ও বামপন্থীদের জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে অংশগ্রহণ, তাহলে শাসক দলের দুর্নীতি ও সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি ভোটের লড়াইয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে আসা অবশ্যই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস দলের মন্ত্রী, নেতা ও কর্মীদের সার্বিক দুর্নীতির যে চিত্র প্রথমে সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে এবং সম্প্রতি নারদা স্টিং অপারেশনের দৌলতে প্রকাশ্যে উঠে এসেছে, তা শুধু তৃণমূল কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকেই কালিমালিপ্ত করেনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন ধরে নিজেকে সততার প্রতিমূর্তি হিসেবে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন, সেই ভাবমূর্তিও এখন দুর্নীতির কালি লেগে মলিন। এই অবস্থায় মমতা এখন ক্রমেই আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি ও তাঁর দলকে এবারের নির্বাচনে এখন কেবলই নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতে নানা কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করার কৃতিত্ব অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর।
এবার নির্বাচনের প্রায় দুই মাস আগে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা যখন আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তত দিনে জেলায় জেলায় ঘুরে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রচারে তাঁর প্রধান বক্তব্য ছিল গত পাঁচ বছরে তাঁর সরকার সাধারণ মানুষের স্বার্থে অনেক ভালো ভালো কাজ করেছে, তাই আবারও মানুষ তাঁদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনুক। কাজের ফিরিস্তির মধ্যে অনেক অতিরঞ্জিত দাবি অবশ্যই ছিল, যেমনটি বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই করে থাকে। যেমন মমতার আমলে নাকি রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার বিশাল উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা নাকি কমেছে। সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে ছাত্রীদের উৎসাহ ভাতা দিচ্ছে, সাইকেল দেওয়া হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে নাকি ৬৯ লাখ চাকরি সৃষ্টি করা হয়েছে। তা ছাড়া মমতার সরকার নাকি রাজ্যের মোট সাড়ে নয় কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে আট কোটি মানুষের জন্য ২ টাকা কিলো দরে পরিবারপ্রতি ৩৫ কিলো চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বলা বাহুল্য, এসব দাবির অনেকটাই ভিত্তিহীন, এমনকি অসত্য। কিন্তু তা হলেও মমতার প্রচারে তখন রাজ্যের গরিব ও সাধারণ মানুষের জন্য জনমুখী উন্নয়নের কথাই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছিল। কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মধ্যে তৈরি হওয়া জোটের বিরূপ সমালোচনা থাকলেও জোর দেওয়া হচ্ছিল সরকারের সাফল্যের তালিকার ওপর।
কিন্তু প্রথমে নারদ স্টিং অপারেশনে একের পর এক তৃণমূল নেতার ঘুষ নেওয়ার ছবি টিভির সুবাদে ছড়িয়ে পড়ল। তার কদিন পরেই কলকাতার ব্যবসাকেন্দ্র বড় বাজারের গায়ে নির্মীয়মাণ একটি উড়াল পুল ভেঙে পড়ায় ২৬ জন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ও আরও অনেকে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটল। তারপরেই প্রাথমিক তদন্তে জানা গেল, ওই উড়াল পুল তৈরির কাজে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়কের আত্মীয়ের একটি ভুঁইফোড় সংস্থা সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি এবং শ্রমিক সরবরাহ করার দায়িত্বে ছিল। এবার কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরোতে লাগল। শুধু ওই উড়াল পুলের নির্মাণের ক্ষেত্রেই নয়, কলকাতা ও রাজ্যের অন্যত্র ছোট-বড় প্রায় সব নির্মাণ প্রকল্পেই শাসক দলের অনুগতদের মাধ্যমে ঠিকাদারি সংস্থাকে বেশি দামে নিম্নমানের মালমসলা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। বড় বাজারের ভেঙে পড়া উড়াল পুলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তৃণমূল নেতার যে সংস্থা সেখানে মালমসলা ও শ্রমিক সরবরাহ করছিল, তাদের ওই সব কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
কলকাতায় মেট্রোরেল সম্প্রসারণের মতো বড় প্রকল্প বা রাজারহাট নিউটাউনে বড় বড় বহুতল আবাসন বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও শাসক দলের অনুগতদের এড়িয়ে বাজার থেকে সরাসরি উন্নত মানের সিমেন্ট, বালু, পাথরকুচি বা ইট কেনার ক্ষমতা নেই নির্মাণের বরাত পাওয়া ঠিকাদার সংস্থাগুলোর। সিন্ডিকেট নামে পরিচিত এসব অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ লোকজন, অসংখ্য সংস্থা এখন রাজ্যের সর্বত্র যাবতীয় নির্মাণ প্রকল্প থেকে এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করছে, যার একটা অংশ পৌঁছে যাচ্ছে তাদের দরদাতা শাসক দলের নেতাদের কাছে। এদের কাছ থেকে কোনো নির্মাণ সংস্থা কাঁচামাল কিনতে অস্বীকৃতি জানালে প্রথমে হুমকি, তারপর সেখানে লোকজন জড়ো করে গায়ের জোরে বাইরে থেকে ইট, বালু, সিমেন্ট নিয়ে আসা ঠিকাদারের লরিকে প্রকল্প এলাকায় ঢুকতে না দিয়ে এরা বাধ্য করে ঠিকাদার সংস্থাকে নতিস্বীকার করতে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকার ফলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেও পুলিশ কিছু করে না। এই সিন্ডিকেটের লোকজন নিজেদের মধ্যে প্রায়ই বখরার ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে, এমনকি মাঝেমধ্যে খুনোখুনিও হয়। ২০১৫ সালে বিধাননগর পুরসভার নির্বাচনে এসব সিন্ডিকেটের ছেলেরাই দলে দলে রাজারহাট থেকে সল্ট লেকে ঢুকে বুথের পর বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়েছিল, সাংবাদিকদের মারধর করেছিল। বিধাননগর পুরসভার (যার অধীনে সল্ট লেক ও রাজারহাট নিউটাউন) মেয়র সব্যসাচী দত্ত সম্প্রতি একটি নিউজ চ্যানেলের কাছে সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি স্বীকার করেছেন, ভোটের সময় এরাই তাদের বাহুবল দিয়ে শাসক দলের প্রার্থীদের জিততে সাহায্য করে। এদের ক্ষতি হলে তৃণমূল সরকারই পড়ে যাবে।
>আক্রমণের মুখে পড়ে মমতা এখন প্রতিটি জনসভাতেই নিজের সরকারের কাজকর্ম নিয়ে বলার বদলে এসব অভিযোগের সাফাই দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দেখাই যাচ্ছে যে নির্বাচনী প্রচারে কোন কোন বিষয় উঠে আসবে, তা মমতা নন, বিরোধীরাই তৈরি করে দিচ্ছেন
সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হলেও বিষয়টি কখনোই সেভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় হয়ে সামনে আসেনি। এবার উড়াল পুল ভেঙে পড়ার কেলেঙ্কারির পরে সিন্ডিকেট বিতর্ক সামনে এসেছে। ফলে জানা যাচ্ছে, শুধু ভেঙে পড়া উড়াল পুলের ক্ষেত্রেই নয়, মেট্রোরেলের যাবতীয় নির্মাণ প্রকল্পে এসব সিন্ডিকেট জড়িত। তা ছাড়া বহুতল বাড়ি নির্মাণে তো আগে থেকেই জড়িত রয়েছে। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে কলকাতায় তৃণমূল কংগ্রেসের জনসভায় মমতা ঘোষণা করেছিলেন, সিন্ডিকেট করলে তাঁর দলে থাকা চলবে না। কিন্তু সেটা যে নেহাতই কথার কথা ছিল, তা এখন স্পষ্ট। বিধাননগর মেয়রের স্বীকারোক্তি এবং ভেঙে পড়া উড়াল পুলের তদন্তে প্রমাণিত, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা সিন্ডিকেট ব্যবসায় ভালোভাবেই জড়িত। মমতা এ নিয়ে আর মুখ খোলেননি।
নারদা ভিডিও টেপ সম্প্রচারিত হওয়ার পরে গোড়ায় তিনি ও তাঁর দলের নেতারা ওই ভিডিও টেপের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। এখন তিনি একের পর এক নির্বাচনী জনসভায় বলছেন, যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, তাহলে ভোটদাতারা তাঁর প্রতি অভিমান করতেই পারেন, কিন্তু আশীর্বাদের হাত যেন সরিয়ে না নেন। মমতার এ ধরনের সুর পরিবর্তনের কারণ, ভেঙে পড়া উড়াল পুলের ছবি ও নারদা টেপের ছবি গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। মানুষ এ নিয়ে আলোচনাও করছে। আর কংগ্রেস, বামপন্থীরা ও বিজেপি এ ব্যাপারে ক্রমাগত ইন্ধন জোগাচ্ছে। সারদা কেলেঙ্কারির ব্যাপকতা বিশাল হলেও ২০১৪ সালে তা নির্বাচনী প্রচারে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। কিন্তু এবার উড়াল পুল ও নারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে সারদাও বিতর্কের মধ্যে চলে আসছে। বাম-কংগ্রেস জোটের তরফে প্রতিটি জনসভাতেই সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, অধীর চৌধুরীরা মমতার সরকারকে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ও সমাজবিরোধীদের সরকার বলে সমালোচনা করছেন। এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাতে সুর মিলিয়েছেন। বৃহস্পতিবার আসানসোল শহরে দলীয় প্রার্থীদের হয়ে নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদিও মমতাকে দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট নিয়েই বললেন। এই দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে পড়ে মমতা এখন প্রতিটি জনসভাতেই নিজের সরকারের কাজকর্ম নিয়ে বলার বদলে এসব অভিযোগের সাফাই দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দেখাই যাচ্ছে যে নির্বাচনী প্রচারে কোন কোন বিষয় উঠে আসবে, তা মমতা নন, বিরোধীরাই তৈরি করে দিচ্ছেন। মমতা শুধু তাতে বাধ্য হয়ে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
রজত রায়: ভারতীয় সাংবাদিক।