২৫ ও ২৬ এপ্রিল পরপর দুদিন ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ। এর কেন্দ্র নেপালে, দুদিন ধরে সেখানে দফায় দফায় ভূমিকম্প ঘটেই চলেছে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞে প্রাণহানি এরই মধ্যে দুই হাজারের কাছাকাছি পেঁৗছেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত ও ভুটানের মতো কাছের দেশগুলোও। উত্তর ভারতেও অর্ধশত প্রাণহানি ঘটেছে। বাংলাদেশেও তিনজন লোক মারা গেছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কিছু ভবন হেলে পড়েছে বলে জানা গেছে। আশপাশের দেশে ভূমিকম্প ঘটলে আমরা কিছুটা নড়েচড়ে বসি। কিছুদিন যেতে না-যেতে আবার বিষয়টি ভুলে যাই। ভূমিকম্প যেহেতু বলে-কয়ে আসে না এবং পৃথিবী থেকে এর বিদায় নেওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই ভূমিকম্পে প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।
একটি ভূমিকম্পের মাত্রা একটিই, যা রিখটার স্কেল দিয়ে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কম্পনের তীব্রতা একাধিক, যা ভূমিকম্পটির উৎসস্থল থেকে দূরত্বের সঙ্গে সাধারণত কমতে থাকে এবং মডিফায়েড মার্সিলি ইনটেনসিটি (এমএমআই) স্কেল দিয়ে প্রকাশ করা হয় (১ থেকে ১২ রোমান সংখ্যার মাধ্যমে)। নেপালে ২৫ এপ্রিলের এই ভূমিকম্পে কাঠমান্ডুতে আট থেকে নয়, ভারতের উত্তরাঞ্চলে সাত থেতে আট, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চার থেকে পাঁচ, ঢাকায় তিন থেকে চার তীব্রতা ছিল। মাত্রা এবং তীব্রতাকে গুলিয়ে ফেলে একত্রীকরণ করা ভুল, যা গণমাধ্যমের কর্মীরা প্রায়ই করে থাকেন। বাংলাদেশ ছোট তীব্রতায় কম্পিত হলেও মানুষ ভয়ংকরভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে।
একসময় ছিল যখন ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় দ্বিতল বাড়ির অধিক উচ্চতার বাড়ি ছিল না। ওই অবস্থায় ভূমিকম্প হলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন বহুতল বা সুউচ্চ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলো থেকে ৩০-৪০ সেকেন্ডের একটি কম্পনের মুহূর্তে গ্যাসলাইন, বিদ্যুৎ লাইন ইত্যাদি বন্ধ করে হাঁকডাক দিয়ে পরিবারের লোকজন সঙ্গে করে বের হয়ে আসা (তা–ও লিফট ব্যবহার করা যাবে না বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে) অসাধ্য। কম্পনের মুহূর্তে এসব সুউচ্চ ভবন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা না করে নিজ নিজ ফ্ল্যাটের মধ্যে আশ্রয় খোঁজা ভালো, যে সম্পর্কে নির্দেশনামূলক লেখা প্রথম আলোসহ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তবে ফ্ল্যাটটি যে বহুতল ভবনে অবস্থিত, সেই ভবন সম্পর্কে বাসিন্দাদের আস্থা থাকতে হবে। এই আস্থা তৈরিতে ভবনকে ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করা দরকার। যে দেশে ভবন ভূমিকম্প ছাড়াই তার নিজ ভারে এবং তার মধ্যে থাকা জিনিসপত্র ও মানুষের ভারে ভেঙে পড়ার একাধিক ঘটনা আছে, সে দেশে এই আস্থা তৈরি সহজ বিষয় নয়।
যে ভবনে একজন বাসিন্দা বসবাস করেন, সেই ভবনটির ওপর বাসিন্দাদের আস্থা তৈরির কাজে দেশের রিয়াল এস্টেট ডেভেলপার, ডেভেলপারদের সংগঠন রিহ্যাব এবং রাজউকের দায়িত্ব অপরিসীম। দেশে থাকা ভূমিকম্পের কোড মেনে তাঁরা ভবন ডিজাইন ও নির্মাণ করছেন কি না, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা দরকার। ভবনের ওপর আস্থার সঙ্গে কম্পনের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ও মাঝারি তীব্রতার কম্পন বছরে কয়েকবার অনুভূত হলে নাগরিকদের মধ্যে একধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এমন কম্পন অনেকবার অনুভূত হয়েছে। কিন্তু কম্পনের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। জাপানের টোকিও শহরে শিনজুকু এলাকায় ৫০ তলা বা তদূর্ধ্ব ভবন কয়েক ডজন আছে। অফিসের সময় বড় তীব্রতার কম্পন হলেও এসব অফিসে কাজ করা লোকজন এক ইঞ্চিও নড়েন না। বরং তাঁরা আশপাশের ভবনগুলোর দোল খাওয়া নিজ ভবনের প্যানারোমিক উইন্ডো থেকে দেখে মজা পান। এর মূল কারণ স্টিলের ফ্রেমের ওপর তৈরি (কিছু কংক্রিটের তৈরি) এসব ভবন কতটা তীব্রতা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে সে সম্পর্কে জনগণের আস্থা।
বাংলাদেশে নতুন তৈরি হওয়া ভবনের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। বিশেষ করে আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলার কার পার্কিং তলাটি শুধু বিম-কলামের ওপর নির্মিত। বিম-কলাম কাঠামোর মধ্যে ইটের বা আরসি ওয়াল বা আরসি/স্টিল ব্রেসিং নির্মাণ করা হয় না। কিন্তু একই ভবনের বাসযোগ্য তলাগুলোতে বিম-কলাম কাঠামোর মধ্যে ইটের কাজ করা দেয়াল থকে। এর ফলে কার পার্কিং তলাটি নিকটবর্তী ওপরের বাসযোগ্য তলার চেয়ে পার্শ্বশক্তি সহনশীলতার বিচারে দুর্বল হয়, যা প্রকৌশল বিষয়ের ভাষায় সফট স্টোরি নামে পরিচিত। ভূমিকম্পের মুহূর্তে একটি ভবন কর্তনীয় ও বক্রনীয় পীড়ন দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই পীড়নদ্বয়ের প্রভাব একটি ভবনের ওপর থেকে যতই নিচের দিকে নামতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে। যেহেতু কার পার্কিং তলাটি ভবনের সর্বনিম্ন তলা, তাই এই তলাটিতে সবচেয়ে বড় মাত্রার কর্তনীয় ও বক্রনীয় পীড়ন কাজ করে।
তবে নিম্ন বা মধ্য উচ্চ তলা ভবনের ক্ষেত্রে বক্রনীয়র চেয়ে কর্তনীয় পীড়নের প্রভাব বেশি হওয়ায় এই কারণেই ভবন সহজে বিধ্বস্ত হয়। জাপান, চিলি, হাইতি, তুরস্ক, তাইওয়ানসহ যেকোনো দেশে ঘটা ভূমিকম্পে ভবনের এই ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে এই বিষয়ে সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে বলে এই ত্রুটি নিয়ে ভবন নির্মাণ হয়েই চলেছে। বিষয়টি নিয়ে সেমিনারে, ওয়ার্কশপে, পত্রপত্রিকায় যখন যেখানে সুযোগ হয়েছে বলেছি বা লিখেছি গত এক যুগের বেশি সময় ধরে। এ বিষয় ইদানীং বা এক যুগ পরে কিছু ভবন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা লক্ষণীয়। তা ছাড়া অল্প কয়েক বছর আগে ইউএনডিপির অর্থায়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর একটি গবেষণায় এর সপক্ষে জোরালো সত্যতা মিলেছিল।
এ ছাড়া আর একটি ত্রুটি হচ্ছে বিম বাদ দিয়ে ভবনকে শুধু পুরু স্লাব দ্বারা নির্মাণ করা। যদিও এর নির্মাণব্যয় অধিক তবুও নির্মাতা/ক্রেতা সবার কাছে এর জনপ্রিয়তার কারণ বিম না থাকায় দেখতে সুন্দর, ফ্ল্যাটের ভেতরে কক্ষ পুনর্বিন্যাস সহজ এবং নির্মাণকাজ সহজ বলে। কিন্তু মোটা পুরু স্লাবের কারণে ভবনের প্রতিতলার ওজন বেড়ে যায়, যা ভূমিকম্পের মুহূর্তে বেশি পার্শ্বশক্তির জোগান দেয় বলে ভবন সহজে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হয়ে একটির ওপর আর একটি ফ্ল্যাট প্লেট স্যান্ডউইচ আকার ধারণ করে, যা অধিক প্রাণহানির কারণ হয়। তাই ফ্ল্যাট প্লেট দিয়ে ভবন নির্মাণ না করে বিম-স্লাব দিয়ে করতে হবে।
যে ভবনগুলো সফট স্টোরি বা পুরু স্লাব দিয়ে তৈরি হয়ে আছে, সেসব ভবনের নিচতলাটি রেট্রোফিটিং করা দরকার। রেট্রোফিটিং বিষয়টি হলো একটি দুর্বল কাঠামোকে শক্তিশালীকরণ। কাঠামোটি যখন নির্মিত হয়েছিল তখন অজ্ঞতাবশত বা যে কারণেই হোক দুর্বলভাবে নির্মিত হয়েছিল, পরে তাকে প্রয়োজনীয় শক্তিশালীকরণই হচ্ছে রেট্রোফিটিং। যদি রানা প্লাজার কলামে ফাটল দেখার পর ব্যবহার থেকে বিরত থেকে ভবনের কলামকে রেট্রোফিটিং করা হতো, তবে ওই বিপর্যয় খুব সহজে এড়ানো যেত। কলামকে আরসি জ্যাকেটিং করে এবং দুই কলামের মাঝে ব্রেসিং, সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল নির্মাণ করে দুর্বল কার পার্কিং তলাটিকে রেট্রোফিটিং করা যায়। এ জন্য সচেতনতার বিষয়টি খুবই জরুরি। ২০ কোটি টাকার একটি ভবনের দুর্বল বা ত্রুটি ২০ লাখ টাকা খরচ করে শক্তিশালী করিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো ইচ্ছা থাকতে হবে।
জাইকার অর্থায়নে ঢাকার সেগুনবাগিচার গণপূর্ত ভবনের একটিতে কয়েকটি পদ্ধতিতে রেট্রোফিটিংয়ের কাজ করে রাখা হয়েছে, যা সহজেই সরেজমিনে দেখা যেতে পারে। এই প্রজেক্টের আওতায় ঢাকার তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন ভবনটিকে রেট্রোফিটিং করা হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ফায়ার স্টেশন ভবন, হাসপাতাল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত ভবন ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবন রেট্রোফিটিং করে ভূমিকম্প সহনশীল করা হবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন সংস্থার অনেক প্রকৌশলীকে কারিগরি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ–সংক্রান্ত প্রকৌশল বিষয়ের ওপর প্রয়োজনীয় তথ্যাদি গণপূর্ত ভবনে যোগাযোগ করে পাওয়া যেতে পারে।
ভবনের নকশা ও কাঠামোর ডিজাইন করার সময় এই ত্রুটির বিষয়টি স্থপতি ও কাঠামো প্রকৌশলীর মাথায় থাকা দরকার। ঢাকার রাজউকসহ দেশের অন্যান্য শহরে প্ল্যান পাস করা কর্তৃপক্ষ যেন কার পার্কিং তলাটিতে বিম-কলামের সঙ্গে আরসি ব্রেসিং বা সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল থাকা বাধ্যতামূলক করে। এ ছাড়া দেশের পাঁচটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও সব কটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে রেট্রোফিটিং বিষয়টি পাঠদানের অন্তর্ভুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে নিরাপদ ভবনে রূপান্তরিত করা দরকার। আর নতুন ভবনগুলো যেন এসব ত্রুটিমুক্ত থাকে, সেদিকে খেয়াল থাকা দরকার। তাহলে ভবনের ওপর বাসিন্দাদের আস্থা সুদৃঢ় হবে।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব। বর্তমানে কম্বোডিয়ার নমপেনে কর্মরত।