আণবিক বোমা হামলা ও হিরোশিমার সাহসী চিকিৎসাকর্মীরা

হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার পরের মুহূর্তের সেই বিখ্যাত ছবি।
হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার পরের মুহূর্তের সেই বিখ্যাত ছবি।

হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘরে শহরের ওপর বোমা হামলার ঘণ্টা তিনেক পরে তোলা দুটি ছবি প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। সেই সময়ে ছবি দুটি তুলেছেন আলোকচিত্রী ইওশিতো মাৎসুশিগে। মাত্র দুটি ছবি তোলার পর ক্যামেরার শাটারে তিনি আর চাপ দেননি। মর্মান্তিকতার অবলোকন ছিল এতটাই ভয়াবহ, সেসব দৃশ্য ধারণ করে রাখায় তাঁর মন আর সায় দিচ্ছিল না। ছবি দুটি এখন আণবিক বোমা হামলার পর সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে তোলা ছবি হিসেবে ইতিহাস হয়ে আছে।

ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঝানু ক্যামেরাম্যান হওয়া সত্ত্বেও শাটারে চাপ দেওয়ার সময় মাৎসুশিগের আঙুল কিছুটা কেঁপে যাওয়ায় ছবি পরিষ্কার ওঠেনি। তা সত্ত্বেও মানুষের যন্ত্রণার গভীরতা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। একটি ছবিতে এক তরুণীকে দেখা যায় লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে, যাঁর কোলে ধরে রাখা আছে কালো হয়ে যাওয়া কোনো বস্তু। কিছুদিন আগে স্থায়ী প্রদর্শনী দেখার জন্য জাদুঘরে গেলে জাদুঘরের পরিচালক কেনজি শিগা সেই ছবির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাদের সাংবাদিক দলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তরুণী তাঁর কোলে কালো যে বস্তুটি জাপটে ধরে আছেন, সেটা ঠিক কী, আমরা তা বুঝতে পারছি কি না। জাদুঘরের পরিচালক নিজেই একটু পরে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, তরুণী কোলে ধরে রেখেছেন পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া তাঁর আপন সন্তান এবং অসম্ভব যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টায় দুপায়ের ওপর তিনি লাফিয়ে চলছেন। অন্য ছবিটিতে দেখা যায়, কয়েকজন নারী-পুরুষকে এক জায়গায় জড়ো হয়ে পাইপ দিয়ে চুইয়ে পড়া পানি হাতের তালুতে সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে। সেই ছবিতেও কয়েকজনের দেহ থেকে ঝুলে পড়া ত্বক বলে দেয় কতটা মর্মান্তিক ছিল বোমা হামলার ঠিক পরের মুহূর্তগুলো।

মানুষের সেই কষ্ট আর বেদনা লাঘবে বোমা হামলার ঠিক পরপর যাঁরা পথে নেমে এসেছিলেন, তাঁরা হলেন নগরীর কয়েকটি হাসপাতালে কর্মরত প্রাণে বেঁচে যাওয়া চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা। তাঁদের মধ্যে অনেকে নিজে আহত হওয়া সত্ত্বেও অনেকটা যেন নিশির ডাক তাঁদের নিয়ে গিয়েছিল দুর্গত মানুষের পাশে। তাই তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা উপেক্ষা করে নারকীয় এক পরিস্থিতির মধ্যে যন্ত্রণাকাতর মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন হিরোশিমার চিকিৎসাকর্মীরা। হিরোশিমার সেসব চিকিৎসক আর চিকিৎসাকর্মীর মধ্যে সেদিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন শহরের রেডক্রস হাসপাতালের কর্মীরা। হাইপোসেন্টার বা বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার কেন্দ্রবিন্দু থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত যে হাসপাতালটির মূল ভবন ধসে না পড়লেও এর চারদিকটা পরিণত হয়েছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া এক বিরানভূমিতে।

বোমা হামলার ঠিক পরপর প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়ে গেলে এর ঝাপটায় কাঠের অনেক বাড়িঘর ধসে পড়ে এবং অল্প সময় পরে দাবানল চারদিকে ছড়িয়ে পরতে শুরু করলে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নগরীর একের পর এক জনপদ। হাইপোসেন্টার থেকে ৫০০ মিটার ব্যাসের ভেতরে থাকা ইস্পাত কাঠামোর সমর্থন নিয়ে তৈরি অনেক কংক্রিট ভবনও বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতায় ধসে পড়েছিল এবং দুই কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের কাঠের বাড়িঘরের সবই মাটিতে মিশে গিয়েছিল। বিস্ফোরণের পর শুরু হওয়া দাবানল চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সত্যিকার অর্থে নরক যেন শহরের ভেতরেই তৈরি হয়ে যায়। সকাল সোয়া আটটার দিকে বিস্ফোরণ ঘটার পর বেলা তিনটা পর্যন্ত উত্তপ্ত হাওয়া শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এবং শহরের বাড়িঘরের ৬৭ শতাংশ এর ফলে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া ২৪ শতাংশ ঘরবাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে মানবদেহের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব যা ফেলে যায়, তা হল তেজস্ক্রিয়া, যে বিষয়টি নিয়ে সেই সময়ে চিকিৎসকদের জ্ঞানও ছিল খুবই সীমিত পর্যায়ের। এর ফলে অনেকেই সনাতন চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করে আহত লোকজনের ক্ষত সারিয়ে তোলায় নিয়োজিত থেকেছেন এবং সেই মহৎ কাজ করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেরাও অজান্তেই তেজস্ক্রিয়ার শিকার হয়েছেন।

হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলায় নিহতদের স্মৃতিতে বানানো স্তম্ভ।

হিরোশিমা রেডক্রস হাসপাতাল চালু হয়েছিল ১৯৩৯ সালের মে মাসে। ২৩৭ শয্যার সেই হাসপাতালে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী নিয়ে ১৭৬ জন শুরুতে কর্মরত ছিলেন। হাসপাতালের পাশাপাশি একটি ভবনে নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার স্কুলও অনেকটা একই সময়ে চালু হয়। আণবিক বোমা হামলার সময় শহরের মোট স্থায়ী জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এর বাইরে আরও ছিল জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর পঞ্চম ডিভিশনের কয়েক হাজার সৈন্য এবং গ্রীষ্মের ছুটিতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জড়ো হওয়া স্কুল ছাত্রছাত্রীর দল। তাদের আনা হয়েছিল প্রধানত নগর কেন্দ্রের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার কাজ করানোর জন্য। শহরে যেহেতু সামরিক বাহিনীর সমাবেশ ছিল, তাই আগুনে-বোমার হামলা হলে আগুনের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার জন্য ঘনবসতির জায়গাগুলো পরিষ্কার করে রাখা প্রয়োজন ছিল। ছাত্রদের সে রকম স্বেচ্ছাসেবী ব্রিগেড মূলত নগর কেন্দ্রে অবস্থান করায় বোমা হামলার সরাসরি শিকার তাদের অনেককে হতে হয়।

বিস্ফোরণের পরপর আহত লোকজনের মধ্যে তখনো যাঁরা সচল ছিলেন, তাঁদের অনেকেই চিকিৎসা পাওয়ার আশায় রেডক্রস হাসপাতালে সমবেত হয়েছিলেন। অন্যদিকে হাসপাতালের কর্মী ও চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে ভেঙে পড়া ভবনের নিচে আটকা পড়ে আহত হয়েছিলেন এবং তাঁদের কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছিলেন। রেডক্রস হাসপাতালে সেই সময় কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মোট সংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ শর কিছু বেশি, যাঁদের মধ্যে ৫১ জন প্রাণ হারান এবং আরও প্রায় ২৫০ জন আহত হন। সে রকম পরিস্থিতি সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে যাওয়া এবং অল্প আঘাত পাওয়া চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা বিলম্ব না করে উদ্ধারকাজ ও আহত লোকজনকে চিকিৎসাসেবা দিতে এগিয়ে আসেন। ওষুধপত্র ও প্রাথমিক চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের চিকিৎসাসামগ্রীর স্বল্পতা চিকিৎসকদের সামনে সেদিন বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবে তা সত্ত্বেও বোমা হামলার অল্প কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু করা চিকিৎসা সাহায্য কর্মকাণ্ড দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই তাঁরা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এক দিন পর পাশের ওকাইয়ামা, ইয়ামাগুচি ও তত্তোরি জেলা থেকে জাপান রেডক্রস সমিতির চিকিৎসক দল হিরোশিমায় যেতে শুরু করলে হিরোশিমার রেডক্রস হাসপাতালের চিকিৎসাকর্মীদের ওপর চেপে বসা কাজের বোঝা কিছুটা লাঘব হয়। তবে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরবর্তী জীবনে তাঁদের অনেককেই ভুগতে হয়েছে।

হিরোশিমা রেডক্রস হাসপাতালের সাহসী সেই চিকিৎসাকর্মীদের হিরোশিমা ভুলে যায়নি। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি জাপান কাটিয়ে ওঠার পর হিরোশিমা রেডক্রস হাসপাতাল নতুন ভবনে উঠে গেছে। সেই হাসপাতাল এখন আণবিক বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষের চিকিৎসার প্রধান একটি কেন্দ্র হিসেবে গণ্য। হিরোশিমার তেজস্ক্রিয়াজনিত অসুস্থ মানুষের অনেকেই সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর যেসব হাসপাতালকর্মী বোমা হামলা ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে হাসপাতালের পাশেই গড়ে উঠেছে স্মৃতি উদ্যান, যেখানে আছে বেশ কয়েকটি স্মারক স্তম্ভ। একটি স্মৃতিফলকে যুক্ত পোর্সিলিন প্যানেলে আঁকা ছবিতে সেসব ছাত্রের মৃতদেহ গোলাকারভাবে পুষ্পস্তবকের মতো বসিয়ে নেওয়া হয়েছে, হিরোশিমায় যাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল নানা রকম কাজ করানোর জন্য। এ ছাড়া সেই উদ্যানের প্রবেশপথে রাখা আছে হাসপাতালের পুরোনো ভবনের একটি অংশ, যার দুমড়ানো লোহার ফ্রেম বলে দেয় কতটা দানবীয় শক্তি সেদিন আঘাত হেনেছিল হিরোশিমা শহরের ওপর।

আগামীকাল পড়ুন: বোমা হামলার স্মৃতি ও নাগাসাকির শিরোইয়ামা প্রাইমারি স্কুল