গত মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দিনের চীন সফরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে সেখানকার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং সহযোগিতার ‘আশ্বাস’ পাওয়ার পর বাংলাদেশে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ওআইসি সম্মেলনে মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিসি) তোলার সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সম্প্রতি আইসিসির একটি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিন অং হ্লাইং, তঁার দ্বিতীয় ব্যক্তি সোয়ে উইনসহ আরও দুজন সিনিয়র অফিসার এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই সেনা কর্মকর্তাদের রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে দেশটি। এটা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত পদক্ষেপ বলে ধারণা করা যায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অং সান সু চির সরকার এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী শঙ্কায় আছে যে যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপীয় দেশগুলো অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশের তরফ থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য নেই।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য ব্রাডলি শেরমান, যিনি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাব-কমিটির চেয়ারম্যান, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে বলেছেন, রাখাইন অঞ্চলকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এ বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পক্ষ খণ্ডন বা সমর্থন করেনি। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন। কয়েক দিন আগে আসিয়ানের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, মিয়ানমার হয় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নিক অথবা উত্তর রাখাইনকে তাদের আবাসভূমিতে পরিণত করা হোক। মালয়েশিয়ায় মিয়ানমারের প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার উদ্বাস্তু রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫ হাজার ১১০ জন রোহিঙ্গা, ২৪ হাজার ৫০০ জন চিন রাজ্যের, ৯ হাজার ৭৫০ জন মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম এবং ৪ হাজার আরাকান বুড্ডিস্ট। (সূত্র ইউএনএইচসিআর, মালয়েশিয়া)। কাজেই মাহাথির নিজেও মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ভুক্তভোগী এক দেশের প্রধানমন্ত্রী। সে ক্ষেত্রে মাহাথিরের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই।
উল্লিখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা পরিষ্কার যে মিয়ানমারের ওপর বহিঃশক্তির চাপ বেড়েছে। ২০২০ সালে সেখানে সাধারণ নির্বাচন। ধারণা করা হয়, এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সামরিক বাহিনী জেনারেল হ্লাইংকে মনোনীত করতে পারে। আগামী বছরের প্রথম দিকে তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সংবিধানে ২৫ শতাংশ সেনাসদস্য সংসদে থাকার বিধান আছে। সু চির এনএলডি এই আইন পরিবর্তন করতে চাইছে। রাজনৈতিকভাবে সু চির সঙ্গে সেনাবাহিনীর কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও রোহিঙ্গা নিধন, বিতাড়ন নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। যত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হবে, তত দিন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এই প্রেক্ষাপটে গত ২৭ জুলাই দুই দিনের জন্য ১৯ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে। যার মধ্যে পাঁচজন আসিয়ানের সদস্যও ছিলেন। তাঁরা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও নাগরিকত্ব না দেওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ফিরে যাবে না বলে জানিয়েছে। তবে প্রায় ৪০০ অমুসলিম রোহিঙ্গা, হিন্দু ও কিছু খ্রিষ্টান রোহিঙ্গা ফিরে যেতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, রাখাইন অঞ্চলে ইতিমধ্যেই ভারত মডেল গ্রাম তৈরি করেছে, যেখানে এই ৪০০ পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হবে।
গত দুই বছরে রোহিঙ্গা সংকট যেভাবে জটিল হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ তো বেটেই, আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বিগ্ন। এমনকি মিয়ানমারের শান্তিপ্রিয় মানুষও চিন্তিত। বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প রয়েছে, কবে এই সমস্যার সমাধান হবে, তা–ও কেউ বলতে পারছেন না। গত ২৭-২৮ জুলাই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) উদ্যোগে এবং ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা সংকটের বিভিন্ন দিক নিয়ে ১৭৫টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ উত্থাপিত হয় ৩৮টি অধিবেশনে। এতে বাংলাদেশ ছাড়াও ২০টি দেশের গবেষক, শিক্ষক ও কূটনীতিকেরা অংশ নেন। এই সেমিনারে যে দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার টেকসই সমাধান।
এই সেমিনার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। প্রধান বক্তা ছিলেন মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানশ্রী দাতো সৈয়দ হামিদ আলবার। তিনি জাতিগত মর্যাদা দিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। আলবার বলেন, মিয়ানমারকে বুঝতে হবে, এ ধরনের জাতিগত নিধন বন্ধ না হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও বিভিন্ন ক্ষমতাধর দেশকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিকল্প উপায়ের প্ররোচনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কূটনৈতিক সমাধানের পথেই থাকবে। তবে সেমিনারে অংশগ্রহণকারী কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কূটনৈতিক সমাধানের পথ সহজ নয়। রোহিঙ্গা সমস্যাটি যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, তত এর সমাধান দুরূহ হবে। সমস্যার সমাধান পেতে হলে মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনীর সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং সেখানকার উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব খর্ব করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মিয়ানমারের আইন ও সংবিধানে, যা গত ৫০ বছরে জারি করা হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীকে খণ্ডিত ও বিকৃত ইতিহাসের মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
রাখাইন বা পুরোনো আরাকানের এইরোহিঙ্গা সংকট যত সহজভাবে দেখা যায়, তত সহজ নয়। রাখাইনের (পুরোনো আরাকান) বিরোধ প্রায় শত বছরের এবং তার আগেও জাতিগত দাঙ্গা সেখানে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জাতিগত এ সংকটের পেছনে আছে রোহিঙ্গা মুসলিম ও স্থানীয় রাখাইন বুড্ডিস্ট সংঘাত। রাখাইন বুড্ডিস্ট ও বর্মি বুড্ডিস্টদের মধ্যে সংঘাত এবং আরাকান আর্মি, তাদের সমর্থক ও মিয়ানমারের বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী এবং সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান সংঘাত বন্ধের পাশাপাশি বৌদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানও রহিত করতে হবে।
একই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত বিরোধের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। রাখাইন ও বঙ্গোপসাগর তটে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতা এবং পশ্চিমা বিশ্বের ভূকৌশলগত স্বার্থে এসব পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল করে তুলছে, যা হয়তো পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সংকট আর মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমিত থাকবে না। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও আঞ্চলিক শান্তির জন্য এই সমস্যা বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মিয়ানমারই, যেখানে ৭০ বছর পুরোনো জাতিগত গৃহযুদ্ধ চলছে।
প্রশ্ন এসেছে, ভবিষ্যৎ মিয়ানমার কি ‘বলকান’ হতে যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদেরই দিতে হবে।
এককথায় রোহিঙ্গা সংকটের ন্যায়ভিত্তিক সমাধান মিয়ানমারের রাষ্ট্রের একতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নৈতিক অবস্থানের উন্নতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা জাতি নিধন একটি মানবিক সংকট। এর পরিণতি কারও জন্য শুভ হতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে হলে মিয়ানমারকে এ বাস্তবতাকে স্বীকার করতেই হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো