লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা গ্রামের রাজ মোহাম্মদ, ঢাকার ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের’ স্বঘোষিত নেতা জালাল উদ্দিন মজুমদার কিংবা শাকিব নামের এক পাগলের কথা কি কারও মনে আছে? এঁদের কথা সম্ভবত আপনাদের মনে নেই। মনে রাখার কোনো কারণ নেই, এঁরা কেউ বিখ্যাত ব্যক্তি নন। এঁদের কথা আমার মাঝেমধ্যে মনে হলেও এঁদের খোঁজখবর নেওয়ার কথা কখনো ভাবিনি। একার্থে তাঁদের ভুলে যাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের কথা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার নানাখী গ্রামের আবুল কালাম আজাদ।
তরুণ আবুল কালাম আজাদকে আমরা আগে চিনতাম না, এখন আমরা তাঁকে চিনি। আজাদ ‘ন্যায়বিচার চাই’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন ২ আগস্ট। তাঁর অভিযোগ যে তাঁর পরিবারের এবং ওই এলাকার অন্যদের জমি জোর করে দখলে নিচ্ছেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি অন্যত্র কোনো রকম ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না দেখে প্রধানমন্ত্রীর দরজায় দাঁড়ানোর পথই বেছে নিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর আজাদকে ওই জায়গা থেকে সরে যেতে হয়। জমিজমা নিয়ে ঝুট-ঝামেলা বাংলাদেশের কোথায় নেই? ফলে এ বিষয় খুব বেশি গড়াত বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপর যা ঘটেছে, সেটাই হয়ে উঠেছে খবরের বিষয়। সেই রাতে র্যাব-১১-এর সদস্যরা স্থানীয় বাজার থেকে আজাদ ও তাঁর চাচাতো ভাই কলেজছাত্র সোহেল মাহমুদকে আটক করেন, তাঁদের বাড়িতে চলে অভিযান, আজাদ ও তাঁর চাচার ঘর তছনছ হয়। আজাদের অভিযোগ তাঁকে, তাঁর মা ও চাচাকে র্যাবের সদস্যরা আঘাত করেছেন। এরপর সোহেলকে র্যাবের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁর কাছে ৩৭০টি ইয়াবা বড়ি পাওয়া গেছে এবং তিনি মাদক ব্যবসায়ী—এ অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। পরে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত কতটা লম্বা, তার একটা চেহারা। ইতিমধ্যে তাঁকে ডেকে নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তাঁর কথা শুনতে চেয়েছেন।
আবুল কালাম আজাদের ভাগ্য একার্থে ভালো যে তাঁর কথা শোনার জন্য হলেও ডেকে নেওয়া হয়েছে, গণমাধ্যমে যে খবর ছিল অনুপস্থিত, সেই বিষয়ে কথা হচ্ছে কিংবা লিমনের মতো দুর্ভাগ্য তাঁকে বরণ করতে হয়নি। ঘটলেই বা কী করা যেত, দুনিয়াজুড়ে আলোচনা সত্ত্বেও সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ২০১৪ সালের অক্টোবরে লিমনের ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘র্যাবের অপারেশনের সময় এমন দু-একটি ঘটনা ঘটেই যায়।’ কিন্তু আজাদের দুর্ভাগ্য যে তাঁর জন্য তাঁর পরিবার বিপদের মুখে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সোহেলের ভাগ্যে কী ঘটবে, আমরা জানি না।
কিন্তু আজাদ কেন আমাকে রাজ মোহাম্মদ, জালাল উদ্দিন মজুমদার কিংবা শাকিবের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেটা ব্যাখ্যা করা দরকার। এ বছরের ৭ এপ্রিল আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচায় ৬৫ বছর বয়স্ক কৃষক রাজ মোহাম্মদ স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তাদের লাগামহীন ঘুষের দাবিতে অসহায় হয়ে একাই একটা মাইক ভাড়া করে মাইকিং করতে শুরু করেন, ‘সবাই এখন ঘুষখোর। কেউ রাখে না কৃষকের খবর। সবাই আসুন, ঘুষখোর অফিসারদের অফিসে তালা লাগাই।’ এ খাতে দুর্নীতির খবর আমাদের জানা থাকলেও এ নিয়ে কোনো দল বা সংগঠনের খুব উদ্যোগ দেখা যায় না। অথচ ২০০৮ সালে টিআইবির জরিপে কী বলা হয়েছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) দেশে দুর্নীতির খাতওয়ারি যে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল দুর্নীতিতে ভূমি প্রশাসনের অবস্থান তৃতীয় এবং টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ভূমি প্রশাসনে। ২০১২ সালে দেশের ৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবারের ওপর টিআইবির পরিচালিত এক জরিপে জানা গিয়েছিল যে এসব পরিবারের ৯২ শতাংশই বলেছে, ভূমি অফিসের কাজ সম্পন্ন করতে তাদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে।
ফলে কমবেশি সবাই জানেন যে আসলে অবস্থাটি কী। কিন্তু কেউ সাহস করে রাজ মোহাম্মদের মতো ‘কাণ্ড’ করেন না। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে এটা তাঁর দায়িত্ব। প্রতিবাদ করতে হবে। তিনি তাই করেছেন, একাই। এমন কাণ্ড করেছিলেন জালাল উদ্দিন মজুমদার। তিনি নিজেকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতা বলে দাবি করলেও তাঁর দলের খবর এর আগে বা পরে আমরা পাই না। ফলে তাঁর কাজকে একার বলেই বর্ণনা করতে হবে। এ বছরের ৩ মার্চ জালাল উদ্দিন মজুমদার পেট্রলবোমা, ক্রসফায়ার, হরতাল, অবরোধ চিরতরে বন্ধের দাবিতে হাতে-পায়ে শিকল পরে গাছে উঠে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। কী কারণে তিনি গাছে উঠেছিলেন? তাঁর ভাষায়, ‘কারণ, মাটিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে ওপরের লোকেরা শুনতে পায় না। তাই গাছের ওপর উঠেই প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হলাম।’
‘ওপরের লোকেরা’ এখন আর কিছু শুনতে পায় না, সম্ভবত শুনতে চায় না। ফলে হয় তাঁদের শোনাতে লাগে মাইক নতুবা দরকার হয় উঁচুতে ওঠা। আরেক সমাধান হতে পারে সশরীরে তাঁদের দরজায় হাজির হওয়া। যেমনটি করেছিলেন শাকিব নামের এক ‘পাগল’। তিনি ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন। তাঁর পরিচয় কী? তিনি বলেছিলেন, তিনি ‘দেশের মালিক’। কিন্তু সশরীরে হাজির হওয়ার পরিণতি ভালো না-ও হতে পারে। আবুল কালাম আজাদের পরিবার তার সাক্ষী। আজাদের প্রশ্ন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো র্যাবের হাতে নির্যাতনের শিকার হলাম। আমরা এখন কোথায় যাব?’
এই সব ‘কাণ্ডকীর্তি’ বিচ্ছিন্ন এবং স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু এসব প্রতিবাদ থেকে বোঝা যায় যে প্রভাবশালীরা কেবল বিত্তের জোরে প্রভাবশালী নয়, তাঁদের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্র। ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য না থাকলে চোখের সামনে জমি দখলের ঘটনা বছরের পর বছর ঘটতে পারে, এমন মনে করার কারণ নেই। কারা ক্ষমতায় আছেন সেটা গৌণ, রাষ্ট্রক্ষমতার জোর দরকার হয়। এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ হলো, সাংসদ কর্তৃক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসতভিটা থেকে শুরু করে সহায়-সম্পদ দখলের ঘটনাও। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ দবিরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল, তাঁদের ওপর হামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ, বিষয়টি যে অভিযোগের বেশি গড়ায়নি সেটাও লক্ষণীয়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নামের সংগঠন অভিযোগ করেছে, পিরোজপুরের সাংসদ এম এ আওয়াল, সংসদের হুইপ মাহবুব আরা গিনি, ফরিদপুরে মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী এক মন্ত্রী, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম তালুকদার সবাই কোনো না কোনোভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর জমিজমা দখলের চেষ্টা করেছেন। আমরা দেখলাম এসব অভিযোগের প্রতিবাদ ও পাল্টা বক্তব্য বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন সাংসদেরা বা তাঁদের পক্ষের লোকজন। কিন্তু এসবের পরিণতি কী হয়? এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, এসবই সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। বাংলাদেশের জনসংখ্যায় হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্রমহ্রাসমান হার তার প্রমাণ। ‘২০১২ সালে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ বসতি এবং পটিয়ায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার পর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্য থেকে ২০০ মানুষের মধ্যে চালানো জরিপে দেখা যায়, রামুর ভয়াবহ সহিংসতার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে দেশত্যাগের প্রবণতা বেড়েছে শতকরা ৩৮ দশমিক ৪৬ ভাগ। এ ছাড়া শতকরা ৭৮ দশমিক ২৪ ভাগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু মনে করেন, দেশের সব স্থানেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ হুমকিতে রয়েছে (উদিসা ইসলাম, ‘নীরব দেশত্যাগ বাড়ছেই’, বাংলা ট্রিবিউন, ১ আগস্ট ২০১৫)। সংখ্যালঘুরা না হয় অনন্যোপায় হয়ে দেশ ছাড়ছেন, কিন্তু যাঁদের জন্য এই ‘শেষ উপায়ও’ নেই, তাঁরা কী করবেন? আবুল কালাম আজাদ সেই প্রশ্নই করেছেন, ‘আমরা এখন কোথায় যাব?’
এই যে অসহায় মানুষেরা, তাদের পাশে রাষ্ট্র নেই, কেননা রাষ্ট্রই তাদের ওপর চড়াও হয়েছে, তাদের পাশে প্রশাসন নেই, কেননা প্রশাসন ব্যস্ত প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে, তাদের পাশে প্রচলিত বিরোধী দল নেই, কেননা তাদের ক্ষমতার সময় এর ব্যতিক্রম ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, নাগরিকদের সংগঠনগুলো, মানবাধিকার সংগঠনগুলো কেন অনুপস্থিত? আবুল কালাম আজাদ একাই প্রধানমন্ত্রীর দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন, রাজ মোহাম্মদ একাই মাইকিং শুরু করেছিলেন। এখনো আজাদকে একাই দেখতে পাই। তাঁর কি একা হওয়ার কথা ছিল?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।