কত বড় পরিহাস একটি জাতির রাজনৈতিক জীবনে হতে পারে, তার একটি উদাহরণ হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার শব্দটি উচ্চারণ না করা। যে ব্যবস্থার জন্য কত হরতাল, কত রক্তপাত হলো, সেই ব্যবস্থার নাম পর্যন্ত নেওয়া আজ বারণ।
গণভবনের সংলাপে বিএনপি এই নাম মুখে নেয়নি। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফায় শব্দটি সুচিন্তিতভাবে পরিহার করা হয়েছে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত সব দেশ এই পরিভাষা ব্যবহার করে। যদিও তারা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন করে। তারা নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন না। কখনো করলেও রাষ্ট্রপতি বা রাজা তাঁকেই নতুন নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ করেন। বাংলাদেশ সংবিধানেও এমন ব্যবস্থা অনুসরণের ব্যবস্থা আছে।
সংবিধানবিশারদ হ্যারল্ড জে লাস্কির ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘গ্রামার অব পলিটিকস’ বইয়ে এভাবে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নতুন নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়কে কেয়ারটেকার সরকার হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের উচিত হবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে বর্তমান মন্ত্রিসভাকে কেয়ারটেকার সরকার হিসেবে উল্লেখ করা। অনেক সময় অজ্ঞতা বা বোঝাপড়ার অভাব সমস্যা সৃষ্টি করে। সংবাদমাধ্যম মনে করতে পারে, কেয়ারটেকার সরকার তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন আমরা তা ব্যবহার করব কেন। আসলে এটি রাজনীতিবিজ্ঞানের একটি পরিভাষা। তাই ব্যবহারিক অর্থে এটা ব্যবহার করা যাবে। ব্রিটেন যে যুগে কেয়ারটেকার বলেছে, তখন তাদের কোনো আইনে তার উল্লেখ ছিল না। ভারতীয় সংবিধান বা আইনের কোথাও কেয়ারটেকার ছিল না। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আশির দশকে প্রধানমন্ত্রী চরণ সিংকে নির্দিষ্ট করে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী বলে রায় দিয়েছেন। তার মানে দাঁড়াল নির্দলীয় নয়, দলীয় মন্ত্রিসভাই নির্বাচনকালে কেয়ারটেকার পরিচয় ধারণ করে। তাই আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভাই হলো কেয়ারটেকার কেবিনেট। তাদের এই নামে ডাকা হলে তারা তাদের অফিসের প্রভাব খাটাতে নিবৃত্ত হবে। কিছু সুফল মিলবেই।
এর মন্ত্রীরা তখন সব সময় মনে রাখবেন, তাঁরা আর আগের মতো সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাঁরা রুটিন কাজের বাইরে যাবেন না। তাঁরা আচার-আচরণে একটা পরিবর্তন আনার দায় বোধ করবেন।
গণভবনের সংলাপে সাধারণ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধানের আওতায় ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন বলে মতামত দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। এত দিন সরকারি দল দাবি করছিল যে বর্তমান সংবিধানের আওতায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার সুযোগ নেই। সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশীদ দাবি করেছিলেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনে এখন সংসদ ভেঙে দেওয়া যাবে না।
কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফা এবং ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার খ উপদফার বরাত দিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, এই দুটি অনুচ্ছেদের আওতায় আগামী নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করা সম্ভব। সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের খ উপদফায় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা এবং সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদে সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের বিধান রয়েছে। সরকারি দল এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। বরং অওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবি করছেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হয় না। অথচ ভারতই লোকসভা ভেঙে সাতটি লোকসভা নির্বাচন করেছে।
বাহাত্তরের ৫৬ অনুচ্ছেদে আরেকটি বিধান ছিল, যা সামরিক আইনে বিলুপ্তির পর আর ফিরে আসেনি। সেটা ফিরিয়ে আনা হলে সংসদ সদস্য নন—এমন এক বা একাধিক ব্যক্তিকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রী করা যাবে। ছয় মাসের মধ্যে কোনো সংসদীয় আসনে তাঁকে জয়ী হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্য সংসদ সদস্য হতেই হবে।
কামাল হোসেন তাঁর সূচনা বক্তৃতায় ১৩তম সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের আলোকে বিশেষ করে দশম ও একাদশ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করা, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা, ২০১৩ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রস্তাবের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১ নভেম্বরের সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের সূত্র ধরেই তিনি তাঁর সূচনা বক্তব্যে ওই রূপরেখা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সব বিষয়ে আলোচনার জন্য তাঁর দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সভাপতি এবং বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়ে—এমন বিষয় নিয়ে আলোচনাও সংবিধানসম্মত।
মনে রাখা ভালো, সংসদ বহাল রেখে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনটিই বাংলাদেশের ইতিহাসের একমাত্র ব্যতিক্রম। সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের ক উপদফা বলেছে, সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হলে সংসদ আপনা–আপনি ভেঙে যাবে। কিন্তু ভেঙে যাওয়া তারিখের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা যাবে। বর্তমান সংসদ প্রথম বৈঠক করেছিল ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। তাই এই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৮ জানুয়ারি ২০১৯।
গণভবনের সংলাপে ড. কামাল হোসেন বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানসম্মত এবং তা ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় রীতি মেনে চলা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অনুশীলনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ।
বাংলাদেশেও ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ব্যতিরেকে এর আগের নয়টি সংসদ নির্বাচন সংসদ ভেঙে দেওয়া অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বঙ্গবন্ধু সংসদের সমাপনী অধিবেশনে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে বিশ্বের বুকে তাঁরা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। তবে তিনি যা বলেননি, তা হলো বিরোধী দল তখনো ক্ষমতাসীন দল দ্বারা পক্ষপাতমূলক আচরণ করার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল। আর সংবিধান তৈরির কাজ শেষ হয়েছে বলেই গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও এটা প্রাসঙ্গিক যে নির্বাচনের সময় তাঁরা কেউ সাংসদ ছিলেন না।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো কার্যকরী গণপরিষদ বা সংসদ ছিল না। ৭ মার্চে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল।
১ নভেম্বর সংলাপের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার আগে তাঁর মতিঝিলের দপ্তরে এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘শতাব্দীপ্রাচীন ব্রিটিশ সংসদীয় রীতিনীতিগুলো আমরা গ্রন্থিত করার চেষ্টা করেছিলাম। ২০১১ সালে ব্রিটেন আইন করে নিয়েছিল যে সংসদ ভেঙে দেওয়া থেকে নির্বাচন করার মধ্যে ১৭ দিনের ব্যবধান থাকতে হবে। পরে তারা সেটা ২৫ দিনে উন্নীত করেছে।’
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে সংবিধানে ওই দুটি বিধান যুক্ত করা হলেও গত ৪৭ বছরের ইতিহাসে ওই দুটি অনুচ্ছেদ কার্যকর করার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। এমনকি এ নিয়ে রাজনীতিতে তেমন আলোচনাও হয়নি। ১৯৭৫ সালে সংসদ ভেঙে গেল। এরপর সংসদ নির্বাচন হলো ১৯৭৯ সালে। সেই সংসদ মেয়াদ পুরা করার আগেই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ভেঙে গেল। এরপর জেনারেল এরশাদের ১৯৮৬ সালের ৭ মে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে গেল। ১৯৮৮ সালের সংসদের মেয়াদ ১৯৯০ সালেই শেষ হলো। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার দাবির মুখে মেয়াদ অবসানের ১৩৩ দিন আগে ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত ষষ্ঠ সংসদ পরের মাসেই ভেঙে যায়। সপ্তম সংসদ থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় সংসদ নির্বাচন সংসদ না থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই সংসদ বহাল রেখে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনটিই একমাত্র ব্যতিক্রম।
ড. কামাল হোসেন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা মনে করি, আজকের আলোচনায় আপনি আমাদের যথাযথভাবে আশ্বস্ত করলে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও তার সামর্থ্য বৃদ্ধিকল্পে সংবিধানসম্মত একাধিক নির্দিষ্ট প্রস্তাব দ্রুততম সময়ে আমরা আপনার সদয় বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারব।’
কিন্তু সংবিধানসম্মত কোনো বিকল্প নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার ধারণা ইতিমধ্যে নাকচ হয়ে গেছে। এখন আশা করব, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ‘কেয়ারটেকার কনভেনশনের’ আলোকে আমাদের নির্বাচনকালীন দলীয় সরকার যেন ওই কনভেনশন মেনে চলে। মন্ত্রীরা কী করতে পারবেন, কী পারবেন না, তার বয়ান বুঝে নিতে এসবের অনুশাসনের অনুসরণ কাজ দেবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে কিছু বাধা–নিষেধ আছে, কিন্তু তা যে কতটা অপ্রতুল, সেটা এসব করভেনশন পাঠ করলেই পরিষ্কার হবে।
আসুন আমরা মেনে নিই, নির্দলীয় সরকার নয়, সংবিধানসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যেটা বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন, সেটা স্বীকার করি। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চে সংসদ নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু নতুন করে শপথ নিতে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি চার দিন পরে শপথ নেন। এই চার দিন সংবাদমাধ্যম তাঁকে ‘তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী’ লিখেছে। ইত্তেফাকে মোটা কাঠের হরফেও তা মুদ্রিত হয়েছিল।