প্রকৃতির খামখেয়ালি আচরণ নতুন কিছু নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর তার চোখে পড়ার মতো আলামত নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মতে, এসব খামখেয়ালির মাত্রা দিনকে দিন বাড়তে থাকবে। বেড়ে যাওয়া খামখেয়ালির সঙ্গে তাল মেলানোর পথ ক্রমে কঠিন হয়ে উঠবে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বৃষ্টির খামখেয়ালি চলছে দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। ঢাকায় মার্চ মাসে কম-বেশি ১২ দিনে প্রায় ৫৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গত ১০ বছরে (২০০৯-১৯) মার্চ মাসে এত বৃষ্টি আর হয়নি। মার্চের আগে ফেব্রুয়ারি মাসেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়। ফেব্রুয়ারিতে চার-পাঁচ দিনে মার্চের প্রায় দ্বিগুণ, মোট ৯৫ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এটা ফেব্রুয়ারির স্বাভাবিক গড় (৩০ মিলিমিটার) থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। এপ্রিলের ৭ তারিখ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে চলতি মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ১০৪ শতাংশ গুণ বেশি বৃষ্টির ধারা অব্যাহত আছে।
তাতে কী ক্ষতি হতে পারে?
হাওরসহ সারা দেশে এটা ফসল তোলার সময়। সে কাজ কোনো কোনো অঞ্চলে বেশ বিঘ্নিত হয়েছে, হচ্ছে। অনেকেই ধান ভালো করে পাকার অপেক্ষায় বসে থাকতে পারেননি। নিচু জমির কাঁচা-পাকা ধান তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে কেটে ফেলতে হয়েছে। যাঁরা বাঙ্গি, তরমুজের ভক্ত, তাঁরা এ বছরে আগাম বৃষ্টির বিস্বাদ চেখেছেন তরমুজ, বাঙ্গিতে। বৃষ্টি নেমে গেলে এই দুটি মৌসুমি ফলের মিষ্টতা কমে যায়। বৃষ্টির পানিতে ফুলে ফেটে যায়। কৃষকের ক্ষতি। অনেক জায়গায় নাবি জাতের ডাল ফসল-সংকটের সংকেতে নাজেহাল। বর্ষাপূর্ব বৃষ্টিপর্বে শিল পড়ে, বাজ পড়ে। আম, কাঁঠাল, লিচুর জন্য শিলাবৃষ্টি ভালো খবর নয়। তবে ফল, ফসল আর খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি ছাড়াও এই বৃষ্টি জনস্বাস্থ্যের ওপর এক মারাত্মক হুমকির সংকেত দিচ্ছে। পানিবাহিত আর মশাবাহিত রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রাজধানীতে এবার স্বাভাবিক সময়ের আগেই মহাখালীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শত শত রোগী ভর্তি হচ্ছে। এখন প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে অন্তত ৮০০ রোগী। গত বছর এই সময় দিনপ্রতি রোগীর সংখ্যা ৪০০-৫০০-এর বেশি ছিল না। হাসপাতালে জায়গা না হওয়ায় বারান্দাতে থাকছে রোগী। প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে মে-জুন মাসে এ রকম পরিস্থিতি হয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন সামনের খোলা জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে হাসপাতাল খোলে। এবার সে উদ্যোগের সময় হওয়ার আগেই রোগীর ঢল নেমেছে। বেশির ভাগ রোগী আসছে টঙ্গী, উত্তরা, মিরপুর, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ী থেকে। অবশ্য প্রকৃতির খামখেয়ালির সঙ্গে রাজধানীতে যুক্ত হয়েছে ‘উন্নয়ন’-এর খামখেয়ালি তৎপরতা। ওয়াসা বলছে, নানা প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পানির লাইনে সমস্যা হয়েছে। মিরপুরে পানিদূষণের অন্যতম কারণ দীর্ঘমেয়াদি খোঁড়াখুঁড়ি। আগাম বর্ষণ না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ওয়াসা ও পয়োনিষ্কাশন লাইনে সমস্যা হয়তো কম হতে পারত।
তবে পানিবাহিত রোগের চেয়ে মশাবাহিত রোগের আশঙ্কা প্রায় আতঙ্কের পর্যায়ে পৌঁছেছে দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে। এই অঞ্চলের যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের আসা-যাওয়া বেশি, তার মধ্যে চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের নাম উল্লেখযোগ্য। চীনে জানুয়ারি ২০১৯-এ গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ মশাবাহিত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় গত ৯ সপ্তাহে ২ হাজার ৬৩১ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে, সেখানে সব মিলিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৫৪৫। গত বছরের তুলনায় এটা ১৫৭ ভাগ বেশি। সিঙ্গাপুরে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, যেখানে গত বছর সব মিলিয়ে ছিল মাত্র ৪৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী।
আমাদেরও কি ভয়ের কারণ আছে?
অভিবাসী, চাকুরে, ব্যবসায়ী, শৌখিন পর্যটক, ছাত্রছাত্রী ও রোগী এই তিন দেশে আর ভারতে (ভারতেও ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে) হামেশায় যাচ্ছেন, আসছেন। এঁদের মাধ্যমে নতুন নতুন রূপের ডেঙ্গু এ দেশে চলে আসা অসম্ভব নয়। তবে দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটাতে প্রয়োজন স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেওয়া এডিস মশা। শীত-হেমন্তে বৃষ্টি বন্ধ হলে স্বচ্ছ পানির ঘাটতিতে এডিসের বংশবৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়। ডেঙ্গুরও প্রকোপ কমে যায়। প্রজনন ও বৃদ্ধিতে সাময়িক বিরতি দিলেও তার ডিমগুলো দুই বছর পর্যন্ত আরামে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। বৃষ্টির পানি মাটিকে একটু ভালো করে ভিজিয়ে দিলেই খটখটে শুকনো মাটিতে ঘাপটি মেরে থাকা এডিস মশার ডিম তাজা হয়ে দ্রুত নতুন মশার বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। শহরাঞ্চলের নানা কোনাকাঞ্চি, দুই বাড়ির মধ্যের চিকন জায়গা বা ফ্ল্যাট বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে অবহেলায় জমে থাকা ময়লায়, অযত্নে পড়ে থাকা টবে কিংবা ড্রামের তলানিতে নিরাপদে ঘুমিয়ে থাকা কোটি কোটি এডিস মশার ডিম গত দুই মাসের বৃষ্টিতে জেগে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দুয়ারের কাছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই এমনটা ঘটেছে। এডিসের জেগে ওঠার খবরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসেছে। ডেঙ্গু দমনে গত ২৭ মার্চ কলকাতায় এক উচ্চপর্যায়ের সভা বসেছিল। রেল, বন্দর, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, রাজ্য, পূর্ত, আবাসন, কলকাতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সবাই ছিল সে বৈঠকে। সভায় রূপান্তরিত ডেঙ্গু নিয়ে বিশেষ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। নতুন ধরনের ডেঙ্গু নিয়ে গত বছর বাংলাদেশ অনেক ভুগেছে। সে ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুর হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। একই মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার ঘটলেও একই ব্যক্তির দুবার চিকুনগুনিয়া হয় না। কিন্তু ডেঙ্গু হতে পারে। গত বছর আমরা সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। ডেঙ্গু তার রূপ পাল্টিয়ে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়ে উঠছে।
কলকাতা পুরসভা ড্রোন ব্যবহার করে সম্ভাব্য এডিস প্রজননক্ষেত্রের ছবি তুলে নাগরিকদের কাছে সেসব ধ্বংসের নোটিশ পাঠাচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এডিস জাগার আগে আমাদেরও জাগতে হবে। আগুন লাগা পরিত্যক্ত ভবনগুলোকেও এই নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com