আগামী বাজেট ও সর্বজনীন জাতীয় পেনশন ভাবনা

সাধারণত সক্রিয় কর্মজীবন শেষের একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমার পর অবসরের বয়স নির্ধারণ করে বয়স্ক মানুষের জন্য যে ভাতার ব্যবস্থা করা হয়, তাকে পেনশন বলা হয়। আমাদের দেশে পেনশন ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমল থেকে চালু হয়েছে, যা শুধু সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বর্তমান সময়ে ‘বয়স্ক ভাতা’ নামে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে দরিদ্র ব্যক্তিদের এ কার্যক্রমের আওতায় মাসে ৬০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়। প্রায় ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষ এর আওতাভুক্ত বলে দাবি করা হয়। তা ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় রয়েছে আরও অনেক কার্যক্রম। ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪৮টি কার্যক্রম নানাভাবে দুস্থ নারী, গর্ভবতী মা, প্রতিবন্ধী, গৃহহীন, অতিদরিদ্র, স্কুল–কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নগদ অর্থসহায়তা করে থাকে। কোভিডকালে সে সহায়তাকে আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আবারও তা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ২০১৯-২০২০ সালে সামাজিক নিরাপত্তা বা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার কোটি টাকায়। ২০২০-২০২১ সালের এ বরাদ্দের ২৪ শতাংশ ও ৭ শতাংশ ব্যয় হয় যথাক্রমে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রদান খাতে। দেশের মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি চাকরিজীবী এবং দেশে বর্তমানে প্রায় ৬০ ঊর্ধ্ব বয়স জনসংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটি। সরকারি কর্মচারীরা দেশের মোট ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের ১ শতাংশ।

বিরাজিত পেনশন ব্যবস্থায় বৈষম্য ও নীতিগত অসামঞ্জস্য

পেনশন এ দেশে নাগরিক অধিকার নয়। এটি সরকারি চাকরির প্রান্তিক সুবিধা। সরকারি চাকরিবহির্ভূতদের জন্য ‘বয়স্ক ভাতা’ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নিরাপত্তাবেষ্টনী, নাগরিক পেনশন নয়। পেনশন গ্রহীতারা বৃদ্ধ বয়সে পেনশনের অধিকারী হওয়ার শর্ত হিসেবে সক্রিয় কর্মজীবনে কোনো অর্থ জমা করেন না বা কোনো আর্থিক কন্ট্রিবিউশন দেন না। দেশে পেনশন গ্রহীতাদের পেনশন দায় মেটানোর জন্য পৃথক কোনো তহবিল সৃষ্টি করা হয়নি। প্রতিবছর জনগণের কর রাজস্ব থেকে সরাসরি অর্থ বরাদ্দ করে পেনশন দায় মেটানো হয়। পেনশনারের জীবনযাত্রার ব্যয় নয়, চাকরির সর্বশেষ পদমর্যাদা ও বেতনক্রম পেনশন অঙ্কের একমাত্র নির্ধারক। তাই অবসরের পর পদমর্যাদাভেদে পেনশন অঙ্ক ৬ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে বিভিন্ন অঙ্কের হয়। সরকারি বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দের ৩১ শতাংশ (২৪+৭) দেড়–দুই লাখ অদরিদ্র ও উচ্চবিত্ত মানুষের কল্যাণ ও আয় সহায়তায় ব্যয় করা কতটুকু যুক্তিসংগত, পেনশনের সঙ্গে আয়কর বা কর ব্যবস্থার কেন সংযোগ নেই, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৯৫ শতাংশের জন্য সক্রিয় কর্মজীবন শেষে কেন পেনশন ব্যবস্থা নেই, সেই প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।

পেনশনের অর্থসংস্থান

বর্তমানে যেভাবে পেনশনারের ব্যক্তিগত কন্ট্রিবিউশন ছাড়া রাষ্ট্রীয় বাজেটের বরাদ্দ দিয়ে পেনশন দেওয়া হয়, তা পৃথিবীর কোথাও আছে বলে জানা নেই। পেনশনের একটি নিজস্ব অর্থনীতি আছে, যা কল্যাণ অর্থনীতির অংশ। টেকসই অর্থনৈতিক নীতি ছাড়া টেকসই পেনশন ব্যবস্থা চালানো সম্ভব নয়। দুনিয়ার কোনো ধনী দেশ একজন নাগরিকের সক্রিয় কর্ম সময়ের কন্ট্রিবিউশন ছাড়া কাউকে পেনশনের অধিকারী করেনি। সে জন্য নাগরিক পরিচয়, সামাজিক নিরাপত্তা ও করব্যবস্থাকে একটি বিশেষ সূত্রে গেঁথে দেওয়া হয়।

আয়কর ব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন ব্যবস্থার সংযোগ

বর্তমানে দেশে টিআইএনধারী মানুষের সংখ্যা ৬০ লাখের কাছাকাছি। আয়কর রিটার্ন জমা দেন ৩০–৩২ লাখ। তার মধ্যে আয়কর দিয়ে থাকেন সর্বোচ্চ ১৩–১৪ লাখ মানুষ। সরকার সরাসরি বা প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বেশি আগ্রহী নয়। তাই এখানে সরকারের রাজস্ব আয়ের ৭০ শতাংশ পরোক্ষ করব্যবস্থার মাধ্যমে আহরিত। সে কর কিন্তু জেনে না জেনে সবাই দিচ্ছে। টেকসই পেনশন ব্যবস্থার জন্য দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের টিআইএন ও যেকোনো একটি অঙ্কের আয়কর দেওয়া আবশ্যক। প্রত্যক্ষ আয়করের অর্থের একটি অংশ ধরা যাক ২-৫ শতাংশ এবং পরোক্ষ করের একই অংশ দিয়ে সরকার একটি জাতীয় পেনশন তহবিল গঠন করতে পারে। সে তহবিল থেকে জাতীয় পেনশন নীতিমালার আলোকে একসময় দেশের সব যোগ্য নাগরিক পেনশন পেতে পারেন।

আয়কর নীতি ও আইনকে জনমুখীকরণ

জাতীয় পরিচয়পত্রধারী সব নাগরিকের টিআইএন থাকতে পারে। থাকতে হবে একটি সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর। আয়করের কোনো নিম্নতম স্ল্যাব থাকবে না। প্রত্যেক কর্মক্ষম নাগরিককে প্রতিবছর ন্যূনতম একটি অঙ্কের আয়কর বা জাতীয় পেনশন প্রিমিয়াম দিতেই হবে, যা নিম্নতম পর্যায়ে আয়ের ১ থেকে ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। এ কন্ট্রিবিউশন সরাসরি তাঁদের পেনশন কন্ট্রিবিউশন হিসেবে পেনশন ফান্ডে জমা হবে। অন্যান্য নানা আয়ের মানুষের দেয় আয়করের একটি অংশ তাদের পেনশন কন্ট্রিবিউশন হিসেবে সরকারের পেনশন ফান্ডে চলে যাবে। আয়কর থেকে পেনশন তহবিলে স্থানান্তরের সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে ৫ শতাংশ। আয়করের পেনশন কন্ট্রিবিউশনের আনুপাতিক হারে কর প্রদানকারী কর্মজীবন শেষে পেনশনপ্রাপ্ত হবেন। এভাবে জনসংখ্যার ২৫ বছরের নিচের এবং ৬২ বছরের ওপরের অংশ বাদে সবাই এ প্রিমিয়াম বা ট্যাক্স নেটে আসবেন। এভাবে দেশের কমবেশি পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিবছর সরকারকে কর দেবে এবং পেনশন তহবিলে কন্ট্রিবিউট করবে। জনপ্রতি গড়পড়তা ৫০০ টাকা ধরলেও তা হবে বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এভাবে প্রতিবছর পেনশন ফান্ডে কমপক্ষে ব্যক্তি কন্ট্রিবিউশন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা হতে পারে। সরকার আয়করবহির্ভূত রাজস্ব থেকে সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। এভাবে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি করে পাঁচ বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল সৃষ্টি করে সর্বজনীন নাগরিক পেনশন ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে পারে।

আগামী অর্থবছরের জন্য পাঁচটি সুপারিশ

১. একটি একক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তা ও সর্বজনীন নাগরিক পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে আসা হোক। অর্থ বা পরিকল্পনা যেকোনো একটি মন্ত্রণালয় নীতিনির্ধারক মন্ত্রণালয় (মুখ্য নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয়) হিসেবে কাজ শুরু করতে পারে। আর সেবাদানকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হিসেবে পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু প্রভৃতি মন্ত্রণালয় কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করবে। অর্থ বা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অধিদপ্তর বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মূল কাজটি সমন্বয় ও নীতি মনিটরিং করবে।

২. সরকার একটি জাতীয় পেনশন ফান্ড গঠন করবে। দেশের সব নাগরিক যাঁদের এনআইডি আছে, তাঁদের সবাইকে একটি সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর এবং একটি টিআইএন নম্বর দিয়ে দেবে। করদাতাদের দেয় আয়করের ৫ শতাংশ সরকারের পেনশন ফান্ডে এবং পেনশনারের হিসাবে সরাসরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানান্তর হবে। যাঁরা কর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নন, তাঁরা বছরে একটি নির্ধারিত অঙ্কের প্রিমিয়াম পেনশন তহবিলে জমা করবেন। এভাবে আয়কর ও পেনশনের একটি সম্পর্ক স্থাপিত হবে।

৩. কর প্রদান বা কোনো কন্ট্রিবিউশন না করলে কেউ পেনশনের অধিকারী হবেন না। এখন বেসরকারি করদাতারা কর দিয়ে তার কোনো সুবিধা পান না। আয়করের সঙ্গে পেনশনকে যুক্ত করলে সে অবস্থার অবসান হবে। দেশে করদাতার সংখ্যাও বেড়ে যাবে।

৪. আগামী অর্থবছর থেকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী যাঁরা সক্রিয় কর্মজীবনে আয়কর দিয়েছেন, তাঁদের পেনশন দেওয়া হোক।

৫. পেনশন আইন ও নীতিমালা, পেনশন তহবিল, পেনশন কর্তৃপক্ষ, এনবিআর ও পেনশন কর্তৃপক্ষ সম্পর্ক ইত্যাদি আইন, নীতিমালা ও বিধির মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার সব ব্যবস্থা অগ্রসর হোক।

ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ