আগামী নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কী হবে

বিএনপি কি একটি বড় দল? বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রায়ই জোরগলায় দাবি করেন, তাঁরা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এমনকি তাঁরা এ-ও বলে থাকেন, তাঁদের দল সবচেয়ে জনপ্রিয়। ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাঁরা বলে যাচ্ছেন—একটি অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করে দেখুন তো একবার, তাতেই বোঝা যাবে কোন দলের জনপ্রিয়তা বেশি?

জাতীয় সংসদের দিকে তাকালে বিএনপিকে বড় দল মনে হয় না। আঙুলে গোনা মাত্র কয়েকজন সদস্য সেখানে এক পাশে পেছনের সারির চেয়ারগুলোয় বসে আছেন। একটা প্রচণ্ড ঝড় এসে গাছের সব কটি আম ফেলে দিলে দু-একটি বোঁটায় যে কয়টা আম ঝুলে থাকে, অনেকটা সে রকম। তারপরও তাঁরা কয়েকজন সুযোগ পেলেই তর্ক-বিতর্ক করেন। তাঁদের শোরগোলে অনেকেরই গাত্রদাহ হয়। খবরের কাগজ পড়ে আমরা যে কথা জানতে পারি।

বিএনপির দিকে তাকালে দলটাকে এখন ছন্নছাড়া মনে হতে পারে। দলের প্রধান নিজ গৃহেই অন্তরীণ। তঁার কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। হয়তো এই শর্ত মেনেই তিনি বাড়িতে আছেন। আমি আইনকানুন কম বুঝি। সবটা বলতে পারব না। দলের ভাইস চেয়ারম্যান তথা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মামলাজটে ফেঁসে গেছেন। ইতিমধ্যে একটি মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। আইনের চোখে তিনি ফেরারি আসামি। ডিজিটাল ব্যবস্থায় দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি।

দলের প্রধান দুই নেতা জনসমক্ষে নেই। এ ছাড়া এমন কোনো নেতা নেই, যাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা নেই। তাঁরা জামিনে আছেন। মাঝেমধ্যেই কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। আবার জামিনে ছাড়া পান। সরকারের ইচ্ছার বাইরে জামিন হয়, এটা আজকাল লোকে বিশ্বাস করে না। কী করলে জামিন বাতিল হয়ে জেলে যেতে হবে, আর কী করলে আবার জামিন পাওয়া যাবে—এসব ভেতরের কথা কাগজে ছাপা হয় না। তবে এর মধ্যে যে একধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি দলের নেতারা অহরহ বলছেন, বিএনপি নিঃশেষ হয়ে গেছে, দেউলিয়া হয়ে গেছে, জীবনে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না ইত্যাদি। ১৪ বছর ধরে তাঁরা একই গীত গাইছেন। দেশে তো আরও দল আছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি তো ক্ষমতাসীন দলের জোটসঙ্গী। তাদের অনেকেরই ঠিকানা-ঠিকুজি খুঁজে পাওয়া যায় না। রীতিমতো হাতে হারিকেন নিয়ে খুঁজতে হয়—তাদের কমিটি আছে কি না, থাকলে কমিটিতে কে কে আছেন ইত্যাদি। একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। কয়েক বছর আগে সাম্যবাদী দল ভাগ হয়ে গেল। খবরের কাগজে পড়লাম, কয়েকজন বিদ্রোহ করে পাল্টা কমিটি বানিয়েছেন। এই প্রথম জানতে পারলাম, সাম্যবাদী দলে দিলীপ বড়ুয়া ছাড়াও লোক আছেন।

আওয়ামী লীগ জানে ও বোঝে দল হিসেবে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ কে। যতই জোরগলায় তাঁরা বলুন, বিএনপি শেষ হয়ে গেছে, বাস্তবে বিএনপির জুজু দিনরাত তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তা না হলে ‘গুরুত্বহীন’ ও ‘বিলীয়মান’ একটি দল নিয়ে কেন এত কথাবার্তা। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতারা কোনো স্কুলের চুনকাম কিংবা গ্রামের কোনো কালভার্ট উদ্বোধন করতে গেলেও বিএনপিকে নিয়ে দু-চার কথা না বললে তাঁদের পেটের ভাত হজম হয় না। কেন অস্বস্তি, এত বিরাগ, এত ক্ষোভ, এত জ্বালা?

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা চল্লিশের কাছাকাছি। আরও কয়েকটি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়ে রেখেছে। এদের নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের তূণের সব তিরের লক্ষ্য হলো বিএনপি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করছে—বিএনপি শেষ হয়ে গেছে, তার পায়ের নিচে মাটি নেই, কর্মীরা হতাশ। তারপরও বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন এত জ্বালা?

প্রায় প্রতিদিন আওয়ামী লীগের বড়, মেজ, সেজ ও ছোট নেতারা নিয়ম করে তাঁদের ওয়াজ-নসিহতে নিজেদের দলের পক্ষে যত না বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে বলেন তার চেয়ে ঢের বেশি। তাঁরা যদি হররোজ এই বয়ান না করতেন, তাহলে তো বিএনপির কথা মানুষ হয়তো ভুলেই যেত। এই যে গোটা চল্লিশেক নিবন্ধিত দলের কথা বললাম, তার মধ্যে কয়টি দল জন-আলোচনায় আছে? কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়—ভাই, দেশে দল কয়টা, নাম কী? তিনি হয়তো চটজলদি তিনটি নাম বলবেন, আর চিন্তাভাবনা করে বা স্মৃতি হাতড়ে হয়তো আরও চার-পাঁচটার নাম বলতে পারবেন। মানুষ তো বাকি দলগুলোর নামই জানে না, কেউ তাদের নিয়ে কোনো আলোচনা কিংবা আগ্রহ দেখায় না। এর মাজেজা কী?

মাজেজা হলো, আওয়ামী লীগ জানে ও বোঝে দল হিসেবে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ কে। যতই জোরগলায় তাঁরা বলুন, বিএনপি শেষ হয়ে গেছে, বাস্তবে বিএনপির জুজু দিনরাত তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তা না হলে ‘গুরুত্বহীন’ ও ‘বিলীয়মান’ একটি দল নিয়ে কেন এত কথাবার্তা। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতারা কোনো স্কুলের চুনকাম কিংবা গ্রামের কোনো কালভার্ট উদ্বোধন করতে গেলেও বিএনপিকে নিয়ে দু-চার কথা না বললে তাঁদের পেটের ভাত হজম হয় না। কেন অস্বস্তি, এত বিরাগ, এত ক্ষোভ, এত জ্বালা? সবকিছুর গোড়ায় আছে বিএনপি-ভীতি। তাঁদের আশঙ্কা, যদি বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসে, তাহলে তাঁদের কী হবে?

দলটি যদি এত দুর্বল ও মাজাভাঙা হয়, তাহলে তারা ক্ষমতায় আসবে কীভাবে? আওয়ামী লীগের বিএনপিবিরোধী লাগাতার প্রচারণা ও গিবত থেকে এটাই মনে হয়, বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে বলে তাঁদের বিশ্বাস এবং যাতে সেটা না হয়, সে জন্য তাঁদের চেষ্টা। অর্থাৎ বিএনপি যে একটা খুব শক্তিশালী দল এবং ভোটে গেলে বিএনপি যে প্রচুর সমর্থন পাবে, এটা আওয়ামী লীগের লোকেরা মুখে না হলেও মনে মনে স্বীকার করেন। তাঁরা বাংলাদেশ বেকার সমাজ, জাতীয় বিপ্লবী ফ্রন্ট, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকান পার্টি, বাংলাদেশ ভাসানী আদর্শ বাস্তবায়ন পরিষদ কিংবা নিবন্ধিত দলগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁদের চোখে বিএনপি মহা শক্তিশালী। তাঁরা বিএনপির বিরুদ্ধে যত বলেন, বিএনপি ততই শক্তিশালী হয়। নিজেদের কথায় ও কাজে বিএনপির শক্তি বাড়ে না, শক্তি বাড়ে আওয়ামী লীগের ঢাক পেটানোয়।

এই যদি হয় বিএনপির অবস্থা, তাহলে তারা এত ছন্নছাড়া কেন? হঠাৎ করে কোনো কর্মসূচি দিলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাঁরা হাজার হাজার লোকের জমায়েত করতে পারেন। ১৪+২=১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি দল যে এত সমর্থক নিয়ে টিকে আছে, এটা বিস্ময়কর। ক্ষমতার রাজনীতিতে অভ্যস্ত একটি দল এত বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও কীভাবে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর জায়গাটি কবজায় রাখতে পারে, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ নিশ্চয় খুব চিন্তিত।

এটা অস্বীকার করার জো নেই, বিএনপি ক্ষমতার রাজনীতি করে। সব দলই করে। তবে সবার ক্ষমতায় যাওয়ার সক্ষমতা নেই। কারণ, তাদের পেছনে জনসমর্থন নেই। বিএনপির আছে। বিএনপি কি তার এই শক্তির গুরুত্ব ও পরিধি বোঝে?

গত দুটি নির্বাচনে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত দুটি নির্বাচনেই তাদের কৌশল মার খেয়েছে। সামনে আসছে আরেকটি নির্বাচন। নতুন একটি নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করেছে। বিএনপি শুরু থেকেই হার্ড লাইনে আছে। এই কমিশন তাদের পছন্দ নয়। কমিশন বারবার সংলাপের আহ্বান জানালেও তারা সাড়া দিচ্ছে না। তারা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু এটা তো নির্বাচন কমিশনের আওতায় নেই। নির্বাচনের সময় সরকার কেমন হবে, তার ভূমিকা কী হবে। এ নিয়ে কথা বলতে ও দেনদরবার করতে হবে সরকারের সঙ্গে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা হবে নির্বাচনের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা কমিশন দিতে পারবে না। যদি না এটা সরকার চায়। বিএনপি এটা ভালো করেই জানে। কারণ, তারাও তো সরকার চালিয়েছে। তাদের সময়ও নির্বাচন কমিশন ছিল।

বিএনপি প্রকাশ্যে কী বলছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নেপথ্যে তাদের অবস্থান ও ভূমিকা কী। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে কি না, তা তারাই ভালো জানে। তাদের মধ্যেও বিকল্প চিন্তা আছে। ‘ফেট অ্যাকমপ্লি’ বা নিয়তির বিধান হিসেবে তারা যদি সংসদে একটা ‘সম্মানজনক’ অবস্থান চায়, তাহলে কয়টা আসন পেলে এই সম্মান বজায় থাকবে, তা লসাগু-গসাগু করে বের করতে হবে। চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার প্রবচন আমরা জানি। আগামী নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কী হবে, তা আমরা জানি না। হয় তারা এমন কিছু করবে, যাতে ক্ষমতার বিন্যাস পাল্টে যায় এবং বিএনপি সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় অথবা যতটুকু পাই ততটুকুই লাভ—এটা মেনে নিয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদে জায়গির হিসেবে থেকে যাওয়া। অবশ্য কোনো মিরাকল কিংবা তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটে গেলে দৃশ্যপট অন্য রকম হয়ে যাবে। এ রকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে?

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক