আজ আক্রমণের মুখে থাকা আমার প্রজন্মের কথা বলব। কারণ, নিশ্চিতভাবে জেনে গেছি, চাপাতির আক্রমণের শিকার আমার প্রজন্ম নিয়ে বলার খুব বেশি কেউ নেই। সুখে থাকুন রাজনীতিবিদেরা। সুখে থাকুন ক্ষমতার মানুষেরা। সুখে থাকুন আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা—তাঁরাও আসলে ক্ষমতারই মানুষ।
চাপাতির নিচে এভাবে, এত দীর্ঘদিন আর কোনো প্রজন্ম থাকেনি। মৃত্যুর ভয় নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় বের হয়নি এমনভাবে আর কোনো প্রজন্ম, কোনো ‘স্বাভাবিক’ সময়ে। শুধু বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো প্রজন্মকে প্রতিদিন এভাবে বিদেশি দূতাবাসে জন্মবৃত্তান্ত জমা দিতে হয়নি। এবং এমন নয় যে তাঁরা বিদেশে যাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন। এমনও নয় যে তাঁরা চোরাকারবারি করেছেন, কাউকে খুন করেছেন, ধর্ষণ কিংবা রাহাজানি করেছেন কিংবা দেশদ্রোহী কাজকর্ম করেছেন। প্রচলিত রাজনীতির ধামাধারীও তাঁরা কেউ নন। তাঁরা এ দেশের তরুণ হিসেবে কেউ লিখেছেন, কেউ বই প্রকাশ করেছেন, কেউ নেহাত এক-আধটু যুক্তির চর্চা করেছেন নিজের ব্লগ বা ফেসবুক দেয়ালে, কেউ বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। এ সবই হতে পারত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এক স্বাধীন জাতির গর্বের বিষয়; অথচ এসব গুণ মারাত্মক অপরাধ বিবেচিত হওয়ায় তাঁরা বাঁচতে পারছেন না। আজ তাঁরা খুন হয়ে যাচ্ছেন ঘাতকের ইচ্ছানুযায়ী, হচ্ছেন নির্বাসিত কিংবা মৃত্যুর ক্ষণ গুনছেন প্রতিদিন।
আমার প্রজন্মের শেষ গৌরবের মৃত্যুবরণ করেছিলেন ছাত্রনেতা মইন হোসেন রাজু। অস্ত্রবাজ দুই ছাত্রসংগঠনের গোলাগুলির মাঝে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘শিক্ষা ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলে না।’ ঘাতকের বুলেটে তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ তাঁকে ক্যাম্পাসে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রমিথিউসের সম্মান দিয়েছিল। রাজু ভাস্কর্য সেই সম্মানের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই-ই শেষ। এরপর আমাদের ক্রমাগত খুন করা হয়েছে, আর সেই সব খুন হয়ে উঠেছে রাজনীতির বলি। তত দিনে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এতটাই প্রকট হয়েছে যে কাউকে ধর্মের দুশমন নাম দিয়ে কেবল তাঁকে খুন করাই জায়েজ হয় না, তাঁর হত্যার বিচার না করলেও চলে, এমনকি তাঁর মৃত্যুতে রাজনীতির মানুষেরা, ক্ষমতার মানুষেরা দুঃখ প্রকাশ করতেও ভয় পান।
২০১৩ সালে যখন আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যা করা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাড়িতে গিয়ে শোক জ্ঞাপন করেছিলেন, রাজীবকে দ্বিতীয় প্রজন্মের শহীদ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। পরে রাজীবকে ‘নাস্তিক’ হিসেবে পরিচিত করে ক্রমাগত বিকৃত প্রচারণার মাধ্যমে তাঁকে ঘৃণার পাত্রে পরিণত করা হয়। সেই ঘৃণা তারপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গোটা শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে। ব্লগার নামের সঙ্গেই সেঁটে দেওয়া হয়েছে নাস্তিক পরিচয়। আর নাস্তিক পরিচয় দেওয়া গেলে তাঁদের হত্যার বিচার না হলেও চলে। ঘটনার দুই বছর পরে এ বছরের ২১ এপ্রিল থেকে বিচার শুরু হয়েছে রাজীব হত্যার।
এরপর ২০১৫ সালে একে একে খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। এই চারজনের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘নাস্তিক’ পরিচয়, ফলে তাঁদের হত্যার বিচারে সরকারের তেমন তৎপরতা থাকবে না, এটা স্বাভাবিক। তবে ভীষণ অস্বাভাবিক ছিল এ বিষয়ে সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে আসা অকপট সব বক্তব্য। তাঁরা বলেছেন, রাষ্ট্রের অন্যান্য অপরাধের চেয়ে এই অপরাধগুলোকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না তাঁরা। সত্যিই এত অকপট উক্তি সরকারের পক্ষ থেকে সচরাচর দেখা যায় না। দেশে কোনো আহমেদ শরীফ বেঁচে নেই, যিনি বলবেন, ‘অষ্টম সংশোধনী হলে এ দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী কিংবা এই যে আমার মতো যাঁরা নাস্তিক, তাঁদের কী হবে?’ জোর দিয়ে কেউ বলেননি, রাষ্ট্রেরসব নাগরিকেরই বাঁচার অধিকার আছে।
এরই মধ্যে দফায় দফায় দেশের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, ব্লগার, সংস্কৃতিকর্মীদের তালিকা করে মৃত্যুর পরোয়ানা ঘোষণা করেছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কখনো বা আল-কায়েদার উপমহাদেশ শাখা। সেই সব হুমকি কিংবা তালিকার কতটা সত্য, সে বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে, অথচ সরকারের তরফ থেকে যাচাই করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে দেখা যায়নি। সরকারের এমন নির্লিপ্ততা বিস্ময়কর।
আর শনিবার দুটি পৃথক জায়গায়, দুটি ভিন্ন বইয়ের প্রকাশনা কার্যালয়ে ঢুকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে এবং হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার-গবেষক রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে—এই নৃশংসতার সঙ্গে কেবল তুলনা করা যায় ঘরে ঢুকে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের হত্যাকে। ফয়সল আরেফিন দীপন ও আহমেদুর রশীদ টুটুল—এ দুজনের অপরাধ তো সেই একটাই, তাঁরা বিজ্ঞানলেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছেন। একই প্রজন্মের লেখক-প্রকাশক খুন হচ্ছেন একই বইয়ের জন্য—লিখে এবং প্রকাশ করে। এরপর কি খুন করা হবে বইয়ের পাঠকদের?
এসব খুনের ব্যাপারে সরকারের বিস্ময়কর নির্লিপ্তির বিষয়ে অবহিত ছিলেন না অধ্যাপক অজয় রায় বছরের শুরুতে, যখন তাঁর
সন্তানকে হত্যা করা হয়েছিল টিএসসির সামনে। তিনি ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রীসম সম্বোধন করে বিচার চেয়েছিলেন। সেই চাওয়ার কোনো ফল যে এখনো মিলেনি, তা আমরা জানি। কিন্তু জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের পিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষক আবুল কাসেম ফজলুল হক এই ভুলটি করেননি। তিনি হত্যাকাণ্ডের বিচার চাননি।
আজ বন্যা আহমেদ, অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী এবং মুক্তমনা লেখক, ফেসবুকে একটি নোট প্রকাশ করেছেন, তিনিও আর অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার চান না এই সরকারের কাছে। একজন পিতার, একজন স্ত্রীর এই প্রকাশ্য অনাস্থা বোঝার মতো কি কেউ নেই সরকারে? রাষ্ট্রে? আমরা কি শুধু আমাদের বন্ধুদের মৃত্যু দেখতে থাকব আর নিজেদের মাথায় মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঘুরব?
তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হলে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কারও বেডরুমে পাহারা দেওয়া সরকারের কাজ নয়। দেশের কোনো মুরব্বি তখন বলেননি, সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয় যেন বেডরুমে মানুষের ঘুম নিশ্চিত হয়। সাগর-রুনি হত্যার বিচার আজও হয়নি। এই বিচারহীনতা, জবাবদিহি না থাকার বলি আমাদের প্রজন্ম।
আমাদের পক্ষে বলার কেউ নেই। যাঁরা বলতে পারতেন, তাঁদের খুন করা হয়েছে একাত্তরে। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা নিজেদের পদ-পদবি নিয়ে ব্যস্ত। আর তাই দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে সরকারি বক্তব্য পাঠ করেন। ক্রমাগত খুন
হতে থাকা লেখক-ব্লগারদের ‘সংযত’ হয়ে লেখার উপদেশ দেন। আইসিটির ৫৭ ধারা বলে মানবাধিকার কর্মী মোহন মণ্ডলকে ধরতে ব্যস্ত সরকার দেখতে পায় না ফেসবুকে দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানানোর জন্য জাতীয় দলের ক্রিকেটার লিটন দাশকে করা সাম্প্রদায়িক মন্তব্য।
এবং আমাদের দুঃখের কোনো পরিসীমা থাকে না, যখন আমাদের মেধাবী তরুণেরা খুন হচ্ছেন ধর্মীয় মৌলবাদী আক্রমণ আর রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায়; প্রতিষ্ঠিত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের পরিতৃপ্ত জীবনে এতটুকু চিড় না ধরিয়ে, তখন আমরা, এই আক্রান্ত প্রজন্মের প্রগতিশীল বন্ধু-স্বজনেরাই ব্যস্ত থাকছি খণ্ডিত হয়ে পরস্পরের দোষ ধরতে। দলে দলে তরুণ ব্লগার, লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট দেশ ছেড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। প্রতিদিন কমে যাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার মানুষ, থেমে যাচ্ছে লেখার কলম।
আক্রান্ত প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের স্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁরা আর নিরাপদ বোধ করছেন না। সরকার যেন তাঁদের দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।
আমি চাপাতি ও আক্রমণের মুখে থাকা আমার প্রজন্মের বন্ধু-স্বজনদের নিরাপত্তা দাবি করি রাষ্ট্রের কাছে। তীব্রভাবে অনুভব করি আক্রান্ত প্রজন্ম হয়েছে ঐক্যবদ্ধ। একই সঙ্গে বিনীত আরও একটি প্রশ্ন আমাকে হতবিহ্বল করে রাখে, রামুর ঘটনার ওপরে ডেইলি স্টার-এর ফোরাম-এ লিখেছিলাম যে কথা, সেই ২০১২ সালে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কে বাঁচাবে? সাতক্ষীরা, রামু, পাবনার সাম্প্রদায়িক হামলায় দেখেছি অসংখ্য কিশোরের অংশগ্রহণ। শনিবার আহমেদুর রশীদ টুটুলকে হত্যা করতে এসেছে যারা, তাদের বয়সও অল্প ছিল বলেই জেনেছি। কী তাদের ভবিষ্যৎ? কে নিশ্চিত করবে তাদের ভবিষ্যৎ?
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।