শোকাবহ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য হেলেনা জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো। এই বহিষ্কার নিয়েও কম নাটক হয়নি। তিনি প্রথমে দলীয় নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, তাঁর কী অপরাধ জানানো হয়নি কিংবা তাঁর কাছে কৈফিয়তও চাওয়া হয়নি।
যারা জেগে ঘুমায়, তাদের জাগানোর কোনো উপায় নেই। জয়যাত্রা টেলিভিশন আইপি টিভির নামে স্যাটেলাইট টিভি পরিচালনা করে আসছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এটি ২০১৮ সাল থেকে হংকংয়ের একটি ডাউন লিংক চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচারিত হয়ে আসছিল। ফ্রিকোয়েন্সির জন্য হংকংকে প্রতি মাসে প্রায় ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করা হতো। হংকং থেকে বরাদ্দ ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচারের কোনো বৈধ অনুমোদন নেই।
এটা তাঁর কাছে অপরাধ মনে হয়নি। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে কোনো অপরাধকেই অপরাধ মনে হয় না। হেলেনা জাহাঙ্গীরের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রচারের জন্য কেব্ল ব্যবসায়ীদের নিকট রিসিভার জয়যাত্রা টিভি বা এর প্রতিনিধির মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। কোনো প্রতিনিধি কেব্ল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সম্প্রচার করতে ব্যর্থ হলে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হতো। বিনা লাইসেন্সের এই টিভি বাংলাদেশের ৫০টি জেলায় সম্প্রচারিত হতো। কোনো টিভি চ্যানেলে বা পত্রিকায় সরকারের মৃদু সমালোচনা হলে নেতা-মন্ত্রীরা শোরগোল তোলেন। আর হেলেনা জাহাঙ্গীরের এই টিভি কীভাবে সরকারের অনুমতি ছাড়া তিন বছর চলেছে, সেই খবর কেউ রাখেননি।
গত ২৯ জুলাই র্যাব হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় চার ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বাসা থেকে বিদেশি মদ, বিদেশি মুদ্রা, হরিণ ও ক্যাঙারুর চামড়া ছাড়াও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম ও ওয়াকিটকি সেট উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে সাংসদ হাজি সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েও র্যাব ওয়াকিটকি জব্দ করেছিল। ক্যাসিনোবিরোধী সফল অভিযানের পরও সদ্য বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেত্রীর বাসা থেকে ক্যাসিনো সামগ্রী ও ওয়াকিটকি জব্দ হওয়া কিসের ইঙ্গিত দেয়? পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আবার তাঁরা এই ব্যবসায় নেমে পড়বেন।
দেশে সরকার আছে, আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে, গোয়েন্দা সংস্থা আছে। এরপরও কীভাবে হেলেনা জাহাঙ্গীর বিনা অনুমতিতে তিন বছর বছর ধরে একটি টিভি পরিচালনা করলেন? তিনি কেবল বেআইনি টিভির মালিক নন; তৈরি পোশাক কারখানার মালিক হিসেবে বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর দাবি, কয়েক লাখ লোকের ভোটে সাংসদ হওয়ার চেয়ে সাড়ে চার কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী এফবিসিসিআইয়ের সদস্য হওয়া অনেক গৌরব ও সম্মানের। ক্ষমতার রাজনীতির হাত ধরে তিনি অনায়াসে সেই জায়গায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ‘বেরসিক’ র্যাব তাঁর সব গোমর ফাঁস করে দিয়েছে।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের টেলিভিশনে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দিতেন। তাঁর টিভিতে যাঁরা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন, তাঁরা কেউ বেতন পেতেন না। উল্টো তাঁদের প্রতি মাসে টাকা দিতে হতো খবর প্রচারের বিপরীতে। অনেক পত্রিকা ও টেলিভিশনই ঢাকার বাইরের প্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা দেয় না বলে অভিযোগ আছে। তাই বলে খবর প্রচারের বিনিময়ে প্রতিনিধির কাছ থেকে নিয়মিত টাকাপয়সা নেওয়ার নজির সম্ভবত এই সদ্য বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেত্রীই স্থাপন করলেন। এই প্রতিনিধিরা নিশ্চয়ই নিজের পকেট (বেতন না থাকলে পকেটও থাকার কথা নয়) থেকে দিতেন না। যে ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের খবর প্রচার হতো তার বা তাদের কাছ থেকে টাকা নিতেন। হেলেনা জাহাঙ্গীরেরা টেলিভিশন সম্প্রচারের নামে সাংবাদিকতাকে কোথায় নামিয়ে এনেছেন!
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে জেলজুলুমের শিকার হওয়া বেশির ভাগই এখন দলে কোণঠাসা। দাপট দেখাচ্ছেন সুযোগসন্ধানীরা। আগে টাকাওয়ালাদের দলে যোগদান নিয়ে সমালোচনা হতো। এখন টাকা কামানোর জন্যই একদল লোক ক্ষমতাসীন দলে ঢুকছেন। নানা পদ–পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন। আর নেতারা বুলন্দ আওয়াজ তুলছেন, যে-ই অপরাধ করুন না কেন, শাস্তি পেতেই হবে।
র্যাবের কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেছেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টেলিভিশনে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিয়ে আসতেন। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাজির করার চেষ্টা করতেন। আমরা দেখেছি, বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ছবি ব্যবহার করতেন, যেগুলো নিজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য, বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণার জন্য। একজন প্রতিনিধি টাকা ফেরত চেয়ে মামলাও করেছেন।
হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী চাকরি লীগ নামে একটি সংগঠনের নামে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি আহ্বান করেছিলেন। বাংলাদেশে এখন যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁরা অলিখিতভাবে আওয়ামী লীগের সদস্য। কোনো কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সে কথা প্রকাশ্যে আমাদের স্মরণ করিয়েও দেন। এরপরও আওয়ামী চাকরি লীগ করার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই দলকে সংগঠিত করা নয়। অন্য ধান্দা ছিল। যে প্রক্রিয়ায় হেলেনা জাহাঙ্গীর তাঁর জয়যাত্রা টেলিভিশনে প্রতিনিধি নিয়োগের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন, সেই প্রক্রিয়ায় হয়তো চাকরি লীগও সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। এখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আর সে জন্য ক্ষমতার আশীর্বাদ দরকার হয়। ক্ষমতার আশীর্বাদ থাকলে বিনা লাইসেন্সে স্যাটেলাইট টিভি চালানো যায়। নানা কমিটির নাম করে চাঁদাবাজি, দখলবাজি করা যায়। ক্ষমতার আশীর্বাদ থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, দলের নেতাদের আনুকূল্য—দুটোই মেলে।
আবার পরিস্থিতি যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন একজন সাহেদ করিম, একজন পাপিয়া ও একজন হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে জনগণকে দেখানো যায়, সরকার আইনের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাশীল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে যখন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো হয়, তখন ক্ষমতার উচ্চ মহল থেকে বলা হয়েছিল, এবারে দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। অন্যায় করে কেউ পার পাবেন না। ইসমাইল হোসেন সম্রাটসহ কয়েকজন ধরাও পড়লেন। কিন্তু তাঁদের নেপথ্যের গডফাদাররা আড়ালেই থেকে গেলেন। আবার কেউ ধরা পড়লেই বলা হয়, এরা অনুপ্রবেশকারী, সুযোগসন্ধানী। পাওয়ার পার্টি পলিটিকসের সদস্য। বিএনপি বা জামায়াতের নেতা-কর্মীরা দলে অনুপ্রবেশ করে সর্বনাশ করে ফেলেছেন। কিন্তু সেই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নেওয়া হয়নি।
যদি আমরা ধরে নিই সাহেদ, পাপিয়া ও হেলেনারা নিজেদের তরক্কির জন্যই দলে এসেছেন; যাঁরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের কি কোনো দায়িত্ব ছিল না? এসব সুযোগসন্ধানীর সঙ্গে নেতারা কেবল ছবি তুলেছেন, না আরও কোনো লেনদেনে জড়িয়েছেন, সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে দেখতে পারে। এখন বলা হচ্ছে এঁরা নানা দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এঁরা দুর্বৃত্ত ও দানব হয়ে উঠেছেন। কিন্তু সেই দানব তৈরির পেছনে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার, সাংসদের মদদ ছিল, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে যাঁরা জেলজুলুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন দলে কোণঠাসা। আর দাপট দেখাচ্ছেন সুযোগসন্ধানীরা। আগে টাকাওয়ালাদের দলে যোগদান নিয়ে আমরা সমালোচনা করতাম। এখন দেখা যাচ্ছে টাকা কামানোর জন্যই একদল লোক ক্ষমতাসীন দলে ঢুকছেন। নানা পদ–পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন। আর নেতারা বুলন্দ আওয়াজ তুলছেন, যে-ই অপরাধ করুন না কেন, শাস্তি পেতেই হবে।
সরকার হয়তো হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার, তাঁর টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করবে। ক্যাসিনো-কাণ্ডে, সাহেদ-কাণ্ডেও এমন দাবি করা হয়েছিল। সাহেদও একসময় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। এমন কোনো নেতা নেই, যাঁর সঙ্গে তাঁর ছবি নেই। সাহেদ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গিয়ে টক শোতে যেসব কথা বলতেন, তাতে মনে হতো দল তাঁকেই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। সাহেদ করিমের আগে পাপিয়ার কেলেঙ্কারি ফাঁস হলো। সেই ঘটনায় দলের অনেক নেতা ও সাংসদের নাম এলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর ফেসবুকে দেওয়ার কারণে শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল নামের এক সাংবাদিককে জেলজুলুমের শিকার হতে হলো।
আওয়ামী লীগে আর কত সাহেদ, পাপিয়া ও হেলেনা আছেন, দয়া করে জানাবেন কি?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।