একাদশ জাতীয় সংসদেরপঞ্চম অধিবেশন শেষ হলো বৃহস্পতিবার। সংসদে কী কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়, তা টিভি দেখে কিংবা পরদিনের পত্রিকা পড়ে জানা যায় না। অথচ নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর জাতীয় সংসদই ছিল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সংসদের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। এমনও দেখেছি, গাড়ি থামিয়ে চালক সংসদের ধারাবিবরণী শুনছেন। সংসদের অধিবেশনে কোন দলের কোন নেতা কী বলেছেন, সেসব নিয়ে বাইরেও বিতর্ক হতো। তখন বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের বাইরে বৈদ্যুতিন কোনো মাধ্যম ছিল না। এখন সংসদ টিভি নামে আলাদা একটি টিভি চ্যানেল চালু হয়েছে, কিন্তু সংসদীয় কার্যক্রম শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। এর কারণ, মানুষ জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে যা শুনতে চায়, তা শুনতে পারছে না।
এই অনাগ্রহ সত্ত্বেও গত কয়েক দিন টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছি সাতাশির গণ-আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে জাতীয় সংসদে কী আলোচনা হয়, তা শোনার জন্য। ১০ নভেম্বর ছিল শহীদ নূর হোসেন দিবস, যিনি ১৯৮৭ সালে বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে মিছিল করেছিলেন। নেতারা সতর্ক করে দেওয়ার পরও তিনি পিছপা হননি। আরও অনেক তরুণের মতো তাঁরও একমাত্র চাওয়া ছিল স্বৈরাচারের পতন। সেদিন নূর হোসেন জিরো পয়েন্টে মিছিল নিয়ে এগোতেই পুলিশ গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। সেই থেকে নূর হোসেন সাহসের প্রতীক। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেরণা।
গণতন্ত্রের জন্য জীবনদানকারী এ রকম সাহসী যোদ্ধাকে কি স্বৈরাচারী এরশাদের খাস শাগরেদ সহ্য করতে পারেন না? ১০ নভেম্বর জাতীয় পার্টির আলোচনা সভায় দলের মহাসচিব মসিউর রহমান ওরফে রাঙ্গা শহীদ নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর’ ও ‘ফেনসিডিলখোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দুই প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ‘নাচানাচিরও’ কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
সংসদে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়, দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বিশেষ করে যাঁদের রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়ে যুবলীগের কর্মী নূর হোসেন বুকে–পিঠে স্লোগান উৎকীর্ণ করে জীবন দিয়েছিলেন, তাঁরা কী বলেন। দেখলাম, গণতন্ত্র ও মহাজোটের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নেতারা জাতীয় পার্টি মহাসচিবের এই ধৃষ্টতা মানতে পারেননি। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘মসিউর রহমানের বক্তব্য শুনেছি। কুৎসিত বক্তব্য দিয়েছেন। একজন সুস্থ মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় এই বক্তব্য দিতে পারেন না। তাঁর এই বক্তব্য সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে ব্যথা দিয়েছে। তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর বক্তব্যের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি। তিনি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও খারাপ মন্তব্য করেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
আওয়ামী লীগের নেতা আমির হোসেন, শেখ ফজলুল করিম, গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুরও মসিউরের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তবে এসব সমালোচনাকে ছাপিয়ে গেছে জাতীয় পার্টির আরেক নেতা ফিরোজ রশীদের তীব্র শ্লেষ মেশানো বাক্যবাণ। তিনি বলেছেন, বান্দরকে লাই দিলে মাথায় ওঠে। মসিউর রহমানের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বানরকে কে লাই দিলেন? ফিরোজ রশীদ যেই দলের হয়ে সংসদে আছেন, মসিউর রহমান সেই দলেরই মহাসচিব ও সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ। সেই দল থেকেই তিনি আগের মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
আক্ষেপের বিষয় হলো, জাতীয় পার্টির মহাসচিবের এই জঘন্য মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছে নূর হোসেনের পরিবারকে। অন্যদের সঙ্গে তাঁর মা ও ভাইও প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু বড় কোনো দলের নেতাকে তাঁদের প্রতি সংহতি জানাতে দেখলাম না। যুবলীগ বা আরও দু–একটি সংগঠন নিয়ম রক্ষার প্রতিবাদ করেছে। আমরা শহীদের আত্মদানের কথা সহজে ভুলে যাই। তাঁদের স্বজনদের কথা মনে রাখি না।
সমালোচনার মুখে মসিউর রহমান জাতীয় সংসদে ক্ষমা চেয়েছেন। একই সঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলেছেন, কোনো সভায় নাকি কারা এরশাদকে গালাগালি করেছেন। আর তিনি সেই গালাগালির জবাব দিয়েছেন শহীদ নূর হোসেন তথা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শরিক দল ও নেতাদের প্রতি বিষোদ্গার করে। যোগ্য নেতার যোগ্য শিষ্যই বটে! ফিরোজ রশীদের বক্তব্য অনুযায়ী, মসিউর রহমান একসময় বিএনপির যুব সংগঠন যুবদল করতেন। আওয়ামী লীগ না করলেও মহাজোট সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। একেই বলে একের ভেতরে বহু রূপ। রাজনীতিতে বহুরূপীদেরই জয়জয়কার।
মসিউর রহমান সংসদে যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই জাতীয় পার্টিই হলো সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল। এরপর সংখ্যার বিচারে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের দুই গ্রুপ, জেপি, তরীকত ফেডারেশনের সাংসদদের অবস্থান। তারা বিরোধী দলের আসনে বসলেও জাতীয় পার্টির ‘নেতৃত্ব’ স্বীকার করে না। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ঠিক করে দিতে পারে না কে বিরোধী দল হবে।
অন্যদিকে সংসদে বিএনপির সাতজন সাংসদ থাকলেও দলটি সংসদের বাইরের দল হিসেবেই পরিচিত। বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতাও সংসদে নেই; যাঁরা আছেন তাঁরা পেছনের সারির। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচিত হয়েও শপথ নেননি। তাঁর ছেড়ে দেওয়া আসনে বিএনপির স্থানীয় এক নেতা জয়ী হয়ে এসেছেন। এ অবস্থায় সংসদের ভেতরে বিএনপির ভূমিকা রাখার সুযোগ কম। আবার সংসদের বাইরেও দলটি খুব তৎপর, তা বলা যাবে না। নয়াপল্টনে দলীয় অফিসে রুটিনমাফিক প্রেস ব্রিফিং, প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও চার দেয়ালের ভেতর প্রতিবাদ সভা আয়োজনের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমিত। বিএনপির সব কর্মসূচি খালেদা জিয়ার মুক্তি বা জামিনকেন্দ্রিক। এর বাইরে জনজীবনে যে হাজারো সমস্যা আছে, সেসব নিয়ে দলের নেতাদের উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না।
রাজনীতিতে সরকারি দল ভুল করলে মানুষ বিরোধী দলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অবস্থা এমন যে মানুষ বিরোধী দলের প্রতিও ভরসা রাখতে পারছে না। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এতটাই স্থবির ও বিশৃঙ্খল যে একের পর এক জ্যেষ্ঠ নেতা পদত্যাগের ঘোষণার পরও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। দলটি কীভাবে চলছে, কে চালাচ্ছেন—বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তাঁরা কেউ জানেন না। যত দিন সরকারের চাপ ছিল, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের ‘প্রতিবাদী চেতনা’ বা জোশ ছিল। এখন তা–ও লুপ্ত প্রায়। দলের নেতৃত্বের সঙ্গে কর্মীদের দূরত্ব বেড়েছে। স্কাইপে কে কী ‘ওহি’ পান, সেটাই দলে আলোচনার বিষয়।
মসিউর রহমান দলীয় সভায় যা বলেছেন, সেটাই মনের কথা। সংসদে দেওয়া তাঁর বক্তব্য আত্মরক্ষার চেষ্টামাত্র। শুধু মসিউর নন, জাতীয় পার্টির আরও অনেক নেতা গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন। রাজনীতি সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় চললে স্বৈরাচারের খেদমতগারেরা এভাবে আস্ফালন দেখাতে পারতেন না। রাজনীতি সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় চললে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা কর্মসম্পর্ক থাকত। কর্মসম্পর্কের কথা বললে আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির আমলের উদাহরণ টানেন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, যারা গ্রেনেড মেরে মানুষ মারে, তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। তাদের ক্ষোভের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলব, বিএনপির সঙ্গে যদি আওয়ামী লীগ কর্মসম্পর্ক না রাখতে পারে, জাতীয় পার্টির সঙ্গে কীভাবে রাখে? জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের পুরস্কৃত করলেও তাদের দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী আরেকটি দল করেননি। সেটি করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁরই বিশ্বস্ত সহযোগী মসিউর রহমান আজ নূর হো্সেনকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করছেন।
বিএনপি তাদের ভুলের কাফফারা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। সেই সঙ্গে এ–ও মনে রাখতে হবে দলটি ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। বাকি ১১ বছর জোটগত কিংবা এককভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সামনে বাইরের কোনো চ্যালেঞ্জ নেই; যেটুকু চ্যালেঞ্জ, তা ভেতরের। সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানে তার কিছু কিছু আলামত আমরা দেখেছি। আওয়ামী লীগ নেতারা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার কথা বলছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের পরিসর সংকীর্ণ থেকে আরও সংকীর্ণতর করে কি তা সম্ভব?
আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে, সংসদের ভেতরে যারা আছে, তারা সবাই সরকারের মিত্র নয়। আবার যারা সংসদের বাইরে আছে কিংবা যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগও পায়নি, তারাও সবাই তাদের শত্রু নয়।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com