আওয়ামী লীগকে কীভাবে ঢেলে সাজানো হবে

এ বছরের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সত্তর পেরিয়ে একাত্তরে পড়েছে। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে দলটির কাউন্সিল সভা। ইতিমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এ নিয়ে কথা বলাবলি করছেন। সাধারণ সম্পাদক হুংকার দিয়েছেন, যাঁদের দুর্নাম আছে, তাঁদের যেন কোনো কমিটিতে রাখা না হয়। কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সামনে রেখে শাখা কমিটিগুলোরও কাউন্সিল সভা হবে। সেখান থেকেই দলে দলে কাউন্সিলররা এসে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি বানাবেন। ইতিমধ্যে ঘোষণা হয়েছে, দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর কাউন্সিল সভাও ডিসেম্বরের আগেভাগে শেষ করতে হবে। শিগগিরই হয়তো এসব নিয়ে তোড়জোড় শুরু হবে।

আওয়ামী লীগ প্রায় ১১ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায়। দলের নেতা-কর্মীরা আশা করছেন, নিদেনপক্ষে আরও ১০ বছর তাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন। দেশ এখন ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ চলছে দ্রুতবেগে। এটি থামানো যাবে না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, যারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, তারা কেউ দেশের উন্নয়ন চায় না।

কাউন্সিলের কিছু পরেই শুরু হবে বছরব্যাপী ‘মুজিব বর্ষ’। তার আয়োজন চলছে এখন থেকেই। চারদিকে কেবলই ‘বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি। যিনি ছিলেন ‘জাতির পিতা’, তাঁকে আওয়ামী লীগ বানিয়েছে দলের সম্পদ। অনেকেই রং বদলে আওয়ামী–ট্রেনে চড়ে বসেছেন। এমনকি ২০ থেকে ৩০ বছর আগেও যাঁরা হক-তোয়াহার দল করতেন, পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা বলতেন, মুখ দিয়ে বাংলাদেশ বের হতো না, তাঁরাও এখন একই ধ্বনিতে অজ্ঞান। তাঁরা ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’। কারণে-অকারণে অনেক জায়গায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। তাঁদের কপাল ভালো, বঙ্গবন্ধু এসব দেখতে পাচ্ছেন না।

রবীন্দ্রনাথ ‘প্রাচ্য সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের পূর্বাঞ্চলে প্রবলা প্রকৃতির পদতলে অভিভূতভাবে বাস করিয়া প্রত্যেক মানুষ নিজের অসারতা ও ক্ষুদ্রতা অনুভব করে, এই জন্য কোনো মহৎ লোকের অভ্যুদয় হইলে তাহাকে স্বশ্রেণী হইতে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া দেবতা-পদে স্থাপিত করে। তাহার পর হইতে তিনি যে কয়টি কথা বলিয়া গিয়াছেন বসিয়া বসিয়া তাহার অক্ষর গণনা করিয়া জীবনযাপন করি; তিনি সাময়িক অবস্থার উপযোগী যে বিধান করিয়া গিয়াছেন তাহার রেখামাত্র লঙ্ঘন করা মহাপাতক জ্ঞান করিয়া থাকি।’

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময়টা যে আমরা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছি, দেশ-সমাজ-বিশ্ব যে কত বদলে গেছে, তা হিসাবে নিই না।

সব জায়গায় আলোচনা চলছে, কাউন্সিলে দলকে ঢেলে সাজানো হবে। এখানে দুটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। এক. দলের নীতি ও কর্মসূচিতে পরিবর্তন আসবে; দুই. দলের নেতৃত্বে অদলবদল হবে। প্রথমটি নিয়ে দলের মধ্যে তেমন আলোচনা নেই। নেতৃত্ব নিয়ে অনেকেই হয়তো উৎকণ্ঠায় আছেন। উপজেলা-জেলা পর্যায়ে অনেক জায়গায় অনেক দিন ধরে কাউন্সিল সভা হচ্ছে না। দল ঢেলে সাজানোর কাজ যদি সেখান থেকে শুরু হয়, তাহলে তার ঢেউ রাজধানীতে এসে আছড়ে পড়বে। কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ নিজ এলাকায় প্রভাববলয় তৈরি করেছেন। কথার মাধ্যমে নয়, কাজের মাধ্যমে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সুবিধা হলো এই যে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে নিজের লোকদের অনেক কিছু পাইয়ে দেওয়া যায়। এর প্রধান বাহন হলো ঠিকাদারি। উন্নয়ন যত বেশি হবে, স্থাপনা যত বেশি তৈরি হবে, ঠিকাদারি ততই প্রসার পাবে। দলে নেতৃত্ব হারানো বা কমিটিতে জায়গা না পাওয়ার অর্থ হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বিলি-বণ্টনের ক্ষমতা হারানো। তার মানে ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’। নেতাদের অনেককেই টিভি চ্যানেলে কথা বলতে দেখি। তাঁদের কারও কারও মুখে হাসি নেই। কয়েক দিন ধরে জুয়া-সুরা নিয়ে যে মাতম শুরু হয়েছে, তাতে অনেকেই আটকে যাওয়ার আতঙ্কে আছেন। এটি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৯৭৪ সালে, যখন চোরাকারবার, কালোবাজার ও মজুতদারি দমন এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। দেখা গেল, যারাই ধরা পড়ছে, অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের উপনেতা-পাতিনেতা কিংবা তাদের আত্মীয়স্বজন। তখন এই ‘শুদ্ধি অভিযান’ বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। শুনতে পাচ্ছি, এবারের শুদ্ধি অভিযান নাকি খুবই সিরিয়াসলি চালানো হচ্ছে। কাউকে নাকি ছাড় দেওয়া হবে না। দেখা যাক কী হয়।

আওয়ামী নেতৃত্ব ঢেলে সাজাতে হলে অনেক পুরোনো মুখকে সরিয়ে নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। সরকারের মন্ত্রিসভায় কয়েকজন নতুন ও
তরুণ মুখ দেখে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য কথায় ও কাজে দক্ষতা দেখাচ্ছেন। তাঁরা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু নতুন মুখ তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না। সাপ্লাই লাইন হতে পারত ছাত্রলীগ-যুবলীগ। তাদের ওপর ভরসা করে আওয়ামী লীগকে ‘উইপোকামুক্ত’ করা খুবই কঠিন হবে।

আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কথায় কথায় বিরাজনৈতিকীকরণের অভিযোগ করেন। তাঁদের কথায় ও কাজে অনেক বৈপরীত্য দেখা যায়। অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যাঁরা প্রবল প্রতাপে রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়েছেন বা এখনো কাঁপাচ্ছেন, তাঁরা কেউই তাঁদের সন্তানদের ছাত্রলীগে সমর্পণ করেননি। কেউ চান না তাঁর সন্তান বেপথে যাক বা নষ্ট হোক। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন ‘উচ্চশিক্ষা’ নিতে অথবা দেশেই রেখে দেন ব্যবসাপাতি করার জন্য। যখন সময় হয়, যখন তাঁদের শরীর ভেঙে পড়ে কিংবা যখন তাঁরা ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁদের সুযোগ্য সন্তানেরা উত্তরাধিকারসূত্রে মা-বাবা-চাচা-মামার নির্বাচনী এলাকাটির মালিকানা পেয়ে যান। যেসব নেতা ‘ছাত্ররাজনীতির’ নোংরা কাদা তাঁদের সন্তানদের গায়ে মাখতে দেন না, তাঁরা এ কাজে ব্যবহার করেন অন্যের সন্তানদের। এই প্রবণতা ডান, বাম, মধ্য—সব রাজনীতিকের মধ্যেই দেখা যায়। যে সুশীলেরা ‘বিরাজনীতিকরণ’ নিয়ে মুখে ফেনা তোলেন, তাঁরাও তাঁদের সন্তানদের আগলে রাখেন ছাত্ররাজনীতি থেকে। সুতরাং নেতৃত্ব গড়ে উঠবে কীভাবে?

তখন হাত বাড়াতে হয় পরিবারের কিংবা অন্য দলের ব্রাত্যদের দিকে। অথবা যাঁকে খুব অনুগত ও বিশ্বস্ত মনে করা হয়, তাঁর দিকে। সম্প্রতি এ রকম উদাহরণ দুটি পাওয়া গেছে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমদ চৌধুরী দলের মনোনয়ন না পাওয়ার আশঙ্কায় গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বানানো হয়েছে। অনেক দিন আলোচনায় না থাকা ‘ফেনীর কৃতী সন্তান’ জয়নাল হাজারীও সম্প্রতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হয়েছেন। কে বলে, আওয়ামী লীগ যোগ্য লোককে স্বীকৃতি দেয় না? আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগে আরও যোগ্য, কর্মঠ ও সজ্জন লোকের সমাবেশ ঘটবে। বয়স এখানে কোনো বাধা নয়। মানুষের গড় আয়ু যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেখানে ৬০-৭০ কিংবা ৮০ কোনো বয়সই না। মনের বয়সই আসল কথা। 

কিন্তু তাঁরা তো হলেন উপদেষ্টা। যখন দরকার পড়বে, দলের সভাপতি তাঁদের পরামর্শ নেবেন। কিন্তু মূল দল চলবে কীভাবে? চালাবেন কারা? একসময় আওয়ামী লীগ ছিল তরুণদের দল। যত দিন শেখ মুজিবুর রহমান দলের কান্ডারি ছিলেন, তারুণ্যের দীপ্তি ছড়ানো ছিল সব জায়গায়। সত্তর দশকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ষাটোর্ধ্ব ছিলেন মাত্র একজন—ফণীভূষণ মজুমদার। দলের সহসভাপতিরা ছিলেন পঞ্চাশের কোঠায়। এখন দলের সভাপতিমণ্ডলী অনেক বিস্তৃত। প্রায় সবার বয়স ৬৫-৭০-এর ওপরে। কেউ কেউ ৮০ পেরিয়েছেন। তাঁরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা হয় তিন বছর পরপর। দলকে ভবিষ্যতে যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের এখন বেছে নেওয়ার সময়। কিন্তু ছাত্রলীগ-যুবলীগের যে অবস্থা, নতুন মুখ আসবে কোথা থেকে? এটা কি দলের জন্য একটি সংকট নয়?

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

mohi2005@gmail.com