আউয়াল দম্পতির জামিন: বিচারিক আদেশে নির্বাহী ছায়া

পিরোজপুরের জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল দম্পতির অবাক জামিনদানের ঘটনায় মুজিব বর্ষে আমাদের সংকল্পকে আরও দৃঢ় করেছে। সংকল্পটা হলো, আমাদের অবশ্যই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে হবে। আজ যদি বাহাত্তরের মূল ১১৬ অনুচ্ছেদটা থাকত, তাহলে বিচারকের বদলি নিয়ে একজন আইনজ্ঞ আইন ও বিচারমন্ত্রীকে এভাবে বিব্রত হতে হতো না। সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে তঁার ব্যাখ্যাদানের প্রশ্নই উঠত না। কারণ, মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ টিকে থাকলে, আর ঝটিকা বদলির দরকার পড়লে এককভাবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হতো সুপ্রিম কোর্টকেই।

বাহাত্তরের সংবিধান লিখেছিল, বিচারকের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা দেখবেন সুপ্রিম কোর্ট। বর্তমানে লেখা: এসব কাজ রাষ্ট্রপতি (কার্যত প্রধানমন্ত্রী) সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন।

সে কারণে পিরোজপুরের জেলা জজকে বদলির (স্ট্যান্ড রিলিজ) আদেশে লেখা আছে, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বদলি করা হয়েছে। এবং যুগ্ম জেলা জজকে ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ করা হয়েছে। এতে সংবিধানের একটি শর্ত আক্ষরিক অর্থে পূরণ হয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার চেতনায় আঘাত লেগেছে।

৪ মার্চে একটি দৃশ্যপট ছিল এ রকম: হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। সেখানে পিরোজপুরের জেলা জজের বদলি বিষয়ে প্রতিকারের জন্য গিয়েছিলেন একজন সংক্ষুব্ধ আইনজীবী। এই আইনজীবী চেয়েছিলেন, আদালত যাতে সুয়োমোটো রুল দেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে কথা বলেন ওই বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি)। তিনি দৈনিক আমাদের সময়–এর বরাতে বলেন, গতকাল দুপুরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইন ও বিচারমন্ত্রীর সাক্ষাৎ ঘটেছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ওই পরামর্শের শর্ত পূরণ হয়েছে। অবশ্য আদালত জানতে চেয়েছিলেন, খবরটি কি বিচার বিভাগের পক্ষে, না বিপক্ষে গেল।

ওই ডিএজির কাছে ৫ মার্চে জানতে চাই, তিনি ইতিমধ্যে নিশ্চিত কি না যে ওই সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি বললেন, না, আমি সংবাদপত্র থেকে পড়েছি। তথ্য যাচাই প্রশ্নে ওই বেঞ্চ রুল দেননি। ওই দিন আরও একটি হাইকোর্ট বেঞ্চে অন্য আইনজীবীরা রুল প্রার্থনা করেছিলেন। পাননি। কিন্তু পরে হাইকোর্টের আরেকটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল দিয়েছেন। স্বপ্রণোদিত হয়েই। সামনে শুনানি হবে।

দুই আইনজীবী (ইউনুস আলি আকন্দ ও এম আব্দুল কাইয়ুম) যাঁদের নিবেদনে আদালত রুল দিয়েছেন, তঁাদের দায়িত্ব বেড়েছে। তঁারা নিশ্চয়ই শুনানিতে অংশ নেবেন। সেই ভরসায় আমরা দু–একটি তথ্য ও ব্যাখ্যার প্রতি তঁাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

আমার এই যুক্তির সঙ্গে মাসদার হোসেন মামলার অন্যতম রায়দানকারী বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী (প্রয়াত প্রধান বিচারপতি) সহমত পোষণ করেছিলেন। যুক্তিটি হলো, বিচারকদের বদলি ও নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বর্তমান ১১৬ অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে। কারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অন্যতম অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচার হিসেবে স্বীকৃত। তাই যে বিধান সরকারকে বিচারে হস্তক্ষেপ করার সাংবিধানিক সুযোগ তৈরি করেছে, সেটা বৈধ হতে পারে না।

পঞ্চম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর নীতি মেনেই আদালত ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন। তাহলে বিচারকেরাই বিচারক বদলাতে পারবেন।

 মুজিব বর্ষে এমন একটি প্রাপ্তি আমরা নিশ্চিত করতে পারলে তা হবে যুগান্তকারী ও মাইলফলক। প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন, এরশাদের আমলে তিনি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। এ সময় নিউমার্কেটের একটি মামলায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এরশাদের রুষ্ট সরকার তঁাকে এই ‘অপরাধে’ ঢাকা থেকে এমন নাটকীয়তায় ফরিদপুরে বদলি করে দিয়েছিল। তিনি স্বীকার করেছিলেন যে মাসদার মামলার শুনানিতে ওই যুক্তি তঁাদের সামনে হাজির না করায় তঁারা তখন তা আমলে নিতে পারেননি।

কিন্তু সময় ফুরিয়ে যায়নি।

আইনজীবী ইউনুস আলি আকন্দর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। যুগ্ম জেলা জজের এখতিয়ার ছিল না বলে আগামী রোববার তিনি একটি নতুন রিট করবেন। তিনি জানালেন, রুলে বলা হয়েছে ‘যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া’ (ডিউ প্রসেস অব ল) অনুসরণ ছাড়াই জেলা জজকে বদলি এবং তঁাকে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করার আদেশ কেন আইনগত এখতিয়ারবহির্ভূত বলে গণ্য হবে না।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আইনি আরও কিছু প্রশ্নের অবতারণা প্রাসঙ্গিক।

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, বিচারক বদলি করতে হলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেবেন। প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ মানেই আপনাআপনি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার শর্ত পূরণ করে কি না।

এই প্রশ্ন নানা সময়ে উঠেছে। বিচারক বদলি জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটির কাজ। সংবিধানের অধীনে সৃষ্টি হাইকোর্ট রুলস। ওই রুলস সৃষ্টি করেছে জিএ কমিটি। প্রধান বিচারপতি ও অপর তিন কর্মরত বিচারপতি কমিটির সদস্য। অনেক সময় যুক্তি দিতে শুনেছি যে জরুরি বা বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় জিএ কমিটি বসে সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তাই অতীতে কোনো এক সময় জিএ কমিটি বা ফুল কোর্ট (হাইকোর্টের সকল বিচারক সমন্বয়ে গঠিত) একটি রেজল্যুশন পাস করেছিল। তাই প্রধান বিচারপতি এ ধরনের ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি’ মোকাবিলায় ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্ণিত ‘সুপ্রিম কোর্টের’ (হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ নিয়ে গঠিত) পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।

জানতে চাইলে বিচারপতি আবদুল মতিন ৫ মার্চে টেলিফোনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এতে কার্যত ওই ধরনের রেজল্যুশনের বৈধতা যাচাইয়ের দরকার পড়বে। কারণ, তিনি বলেছেন, সংবিধানের অধীনে জিএ কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর এটা হলো ডেলিগেটেড পাওয়ার। সুতরাং যঁারা ইতিমধ্যেই হস্তান্তরিত ক্ষমতা অনুশীলন করছেন, তঁারা পুনরায় সেই ক্ষমতা ডেলিগেট বা হস্তান্তর করতে পারেন না।

পিরোজপুরের ঘটনায় ‘ডিউ প্রসেস’ খতিয়ে দেখতে আরেকটি বিষয় হলো, জামিন না পেয়ে পিরোজপুরের আইনজীবী সমিতির ‘বর্জন’ সিদ্ধান্ত আদালত অবমাননার শামিল কি না। এটা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রণীত ‘ক্যাননস অব অ্যাটিকেটের’ প্রতি মারাত্মক আঘাত বলেই প্রতীয়মান হয়।

এ ছাড়া যুগ্ম জেলা জজ ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই জামিন মঞ্জুর করতে পারেন কি না। সাধারণত কাউকে বদলির পর তঁার আদেশ দ্রুত আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও তা দেখলাম না। তবে দায়িত্বশীল সূত্রে পাওয়া একটি আদেশে লেখা আছে, যুগ্ম জেলা জজ ৩ মার্চ বেলা তিনটায় ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব নেবেন। পিরোজপুরের যুগ্ম জেলা জজকে স্পেশাল জজের দায়িত্ব অর্পণ করার কথা জানা নেই।

২০০৪ সালের দুদক আইনের ২৮ ধারা বলেছে, দুদকের মামলার বিচার স্পেশাল জজ করবে। সুতরাং নির্দিষ্টভাবে দুদকের মামলায় স্পেশাল জজের এখতিয়ার না থাকা কোনো একজন ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করতে পারেন না। দুদকের মামলা শুনতেই পারেন না। তাই তর্কিত জামিন আদেশটি ‘কোরাম নন জুডিশের’ (যথাযথভাবে আদালত গঠিত না হওয়া) দোষে দুষ্ট বটে।

 জামিনের দরখাস্ত নাকচ হলেও বারবার করা যায়। কিন্তু নতুন কারণ দেখানো ও জানতে চাওয়া যথাক্রমে আইনজীবী ও বিচারকের পেশাগত কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ৩ মার্চে জামিন অগ্রাহ্য হওয়ার পরে সাবেক সাংসদ আবদুল আউয়াল দম্পতি পুনঃ আবেদন করেছিলেন। তাঁদের আবেদনক্রমেই ডিভিশন ও হাসপাতালবাসের দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছিল। সুতরাং ভারপ্রাপ্ত জেলা জজের সামনে কোনো নতুন কারণ ছিল বলে অনুমিত হয় না।

আশায় থাকব, উল্লিখিত সাংবিধানিক ও আইনি বিষয়গুলো শুনানির মাধ্যমে পরিষ্কার হবে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com