কাল রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনী পরিবেশ–পরিস্থিতি, ভোটারদের আকাঙ্ক্ষা ও স্থানীয় রাজনীতির নানা মতবিরোধ নিয়ে লিখেছেন একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য সেলিনা হায়াৎ আইভীই ‘বেস্ট বেট’ এবং আইভীর জন্য নৌকাই সবচেয়ে জুতসই মার্কা। কেননা নৌকার বিশাল ভোটব্যাংকের বাইরেও তাঁর নিজস্ব ‘সুশীল’ একটা পকেট আছে। আওয়ামী পরিবারে তাঁর জন্ম, তিনি নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের কিংবদন্তি নেতা আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়ার কারণে বামপন্থীদের কাছেও তিনি অপ্রিয় নন। শামীম ওসমানের কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হয়েও যাঁরা নৌকায় ভোট দেন না, তাঁরাও নির্দ্বিধায় আইভীকে ভোট দেবেন। ওসমান পরিবার চাইলেও আওয়ামী লীগের খাঁটি সমর্থকদের নৌকায় ভোট দেওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই ভোটের অঙ্ক পুরোটাই আইভীর অনুকূলে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মনে কোনো উচ্ছ্বাস নেই! বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নৌকায় চড়ে আইভী পার হয়ে যাবেন, শামীম ওসমানের পক্ষেও তা মেনে নেওয়া কঠিন। তিনি নিশ্চয়ই বুক চাপড়াচ্ছেন! তা ছাড়া দল যে আইভীকে খুব একটা বিশ্বাস করে, এমনও নয়। যদি কখনো খারাপ সময় আসে, আইভী নিশ্চিত ‘সুশীল’ পক্ষই নেবেন। তারপরও জাতীয় নির্বাচনের দুই বছর আগে আওয়ামী লীগ সব অস্বস্তি নিয়েও আইভীকে প্রার্থী করেছে কেবল শতভাগ জয় নিশ্চিত করার স্বার্থে। আইভীর বদলে আওয়ামী লীগের অন্য কাউকে প্রার্থী করা হলে আইভী অবশ্যম্ভাবীভাবে বিদ্রোহী প্রার্থী হতেন। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই বিএনপির কোর্টে চলে যেত। বিএনপি-জামায়াতের ভোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাংশ যুক্ত হয়ে ‘অ্যান্টিইনকামবেন্সি’র ওপর ভর করে নৌকাবিরোধী সেই প্রার্থী অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের এ বিকৃত খেলা ভালোই সাফল্য পেয়েছে!
কিন্তু তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় অঙ্কটা এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। ধানের শীষ মার্কা না নেওয়ায় তাঁর ভোট জামায়াত-বিএনপির সাধারণ হিসাবের চেয়ে বাড়বে। অ্যান্টিইনকামবেন্সিও তাঁর পক্ষে যাবে। ওসমান পরিবারের সমর্থন পাওয়া গেলে তিনিও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চলে আসতেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য একজন প্রার্থী। তাই আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে শামীম ওসমানকে দিয়ে আইভীর পক্ষে প্রকাশ্য ঘোষণা দিইয়েছে। আইভী কিন্তু তাতেও ওসমান পরিবারকে কটাক্ষ করা থামাচ্ছেন না, কেননা ওসমান পরিবারবিরোধী ভোটও তাঁর চাই! ১২ বছর মেয়র থাকার পর, অ্যান্টিইনকামবেন্সি যাতে তাঁকে ধরাশায়ী করে ফেলতে না পারে, সে জন্য পরিকল্পিতভাবেই তিনি অ্যান্টিএস্টাবলিশমেন্ট অবস্থান নিয়েছেন।
তবে তিনি এখানেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের অন্য ত্যাগী নেতা-কর্মীদেরও তিনি অনবরত তাচ্ছিল্য করছেন। তা ছাড়া ‘সুশীল’ পত্রিকাগুলোর সমর্থন অব্যাহত রাখতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মিডিয়ার ওপরও চড়াও হচ্ছেন। এতটুকু কূটকৌশল সহজেই অনুমেয়! কিন্তু তিনি যা করছেন, তা নেহাত কৌশলের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
তিনি কি তবে চাইছেন আওয়ামী লীগের ভোটাররা যেন তাঁকে ভোট না দেন? উদারপন্থী গণমাধ্যম যেন তাঁর বিপক্ষে চলে যায়? নিজে হেরে হলেও কি তিনি নৌকা ডোবাতে চান? জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে আওয়ামী লীগকে হারের ধারায় নিয়ে যাওয়াই কি তাঁর ‘ব্রিফ’? তখন বিএনপি-জামায়াত জোরগলায় বলতে পারবে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই আওয়ামী লীগ হারে’।
এত সব জটিল প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও খানিকটা সময় লাগবে। তবে এ যাত্রায় আইভীর কৌশল যে সফল হচ্ছে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সূতিকাগার, দলটির নেতা–কর্মীরা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়েও তাঁকে বড় ব্যবধানে জিতিয়ে আনবেন। তবে জয়ী হয়েও দলের আস্থা ফিরে পাওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে তিনি সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারবেন, যদি না সরকার সে এলাকাকে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার আওতায় এনে আমূল কোনো পরিবর্তন ঘটায়। আইভীকে ব্যাপক হাততালি এবং আগাম অভিনন্দন!