ইদানীং রাজনীতি

আইন আছে, তাতে কী!

তনুর জন্য শুধু না, ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হবে তরুণদেরই
তনুর জন্য শুধু না, ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হবে তরুণদেরই

আইন আছে কি নেই বা আইন থাকলে তাতে কী বলা আছে বা কী বলা নেই, তা নিয়ে আজকাল মাথা ঘামানোর লোকের সংখ্যা দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। এ যুগ হলো আমার যা ইচ্ছা তা-ই করার যুগ। আইন নিয়ে মাথা ঘামানোর যুগ প্রায় শেষ। অবশ্য সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি। আইন যদি আমার পক্ষে যায় তাহলে আইন চাই, আইন চাই বলে চেঁচিয়ে পাড়া সরগরম করব। কিন্তু আইনে যা বলা আছে তা যদি আমার বিপক্ষে বা বিরুদ্ধে যায়, তাহলে আইনকে বেমালুম উপেক্ষা করব। ক্ষমতা তো আমার। এই ধরেন সোহাগী জাহান তনুর ব্যাপারটা। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় দুই সপ্তাহ পেরোতে চলল। যখন এই লেখা লিখছি তখন পর্যন্ত ধরে থানায় নিয়েছে কাকে? তাঁর মা ও নিকট আত্মীয়দের। কখন? মাঝরাতে।
এমন কোনো ভীষণ দুর্ধর্ষ অপরাধীর খবর পুলিশ পেল, যাকে দিন হোক, রাত হোক এক্ষুনি ধরতে হবে, নাহয় সেই অপরাধী গুলি মেরে, বোমা মেরে জঘন্যতম অপরাধ করে ফেলবে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ধরা যৌক্তিক। তনুর নিকটতম আত্মীয়দের র‍্যাব ধরে আনল একেবারেমাঝরাতে। আইন আছে, তাতে কী! মনে হচ্ছে এ দেশের মানুষের যেন নির্মম থেকে নির্মমতর আচরণ আর নির্যাতনই প্রাপ্য। এ দেশে ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হলে কেউ লাভবান হয় কি না কে জানে!নিহত তনুর মাও যদি নির্মম-নিপীড়নমূলক আচরণ থেকে রেহাই না পান, তাহলে পাঠক-আমি-আপনি কোন ছার। চরম নির্মম অপরাধের শিকার এক তরুণীর মা—তিনিও মধ্যরাতের নির্যাতন থেকে রেহাই পেলেন না।

টেলিভিশনের সংবাদে দেখলাম নিহত তনুর পিতামাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। নিহত তনুর পিতামাতা অবশ্যই সরল বিশ্বাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পা, সাহায্য ও দিকনির্দেশনার জন্যই তাঁর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর শত-হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও তনুর পিতামাতার মতো ভুক্তভোগীদের সময় দিয়ে থাকেন। আশ্বাস দেন, আশ্বস্ত করেন। এ দেশের নাগরিকদের দুঃখ-দুর্দশায় একেবারে ব্যক্তিগতভাবে পাশে দাঁড়ানো বরাবরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি মহানুভবতা। কিন্তু উত্তরোত্তর বহু নাগরিকই যখন অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা বা হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে বলে যত বেশি মনে করবে এবং সে জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, ততই সরকারযন্ত্রের ওপর, মন্ত্রণালয়ের ওপর, সরকারের দপ্তর-অধিদপ্তরের ওপর অনাস্থার প্রতিফলন হবে।

র‍্যাব আছে, পুলিশ আছে, আছে ডিবি, সিআইডি। যেহেতু ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে, সে সুবাদে সেনাবাহিনীও তনু হত্যার সুরাহা করতে সবকিছু করার আশ্বাস দিয়েছে। তারপরও দরকার খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি বুঝতে পারছেন না যে তাঁর ওপর ভুক্তভোগীদের আস্থা কমে যাচ্ছে বা নেই হয়তো। ওয়াসা বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের খোঁড়াখুঁড়ি আর যানজট থেকে রেহাই পেতে অচিরেই হয়তো আমরা ঢাকাবাসীকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হতে হবে।

মেক্সিকোতে যত খুন হয়—এবং খুন হয় এন্তার—সে দেশের পুলিশ সুরাহা করতে পারে তার কমবেশি ২ শতাংশ। লন্ডনে যত খুন হয়, পুলিশ তার সুরাহা করতে পারে ৯৫-৯৬ শতাংশ। তনুর খুনের বিচারের দাবিতে সারা দেশের ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী বহু জায়গায় রাস্তায় নেমেছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ২০-২৫ বছর ধরে তোমরা রাস্তায় নেই। আন্দোলনে নেই, রাজনীতিতে নেই, তাই এখন হঠাৎ করে একটা-দুটো অন্যায়ের প্রতিকার চাইলে তা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রাজনীতির মাঠে তোমাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সরকারযন্ত্র এখন পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ। তোমরা ভেবেছিলে রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে নির্বিঘ্নে থাকবে, নির্ঝঞ্ঝাট থাকবে, ঝামেলামুক্ত থাকবে জীবন। তোমাদের বোঝাটা ছিল ভুল। শুধু তনু হত্যা না, প্রায় কোনো অন্যায়েরই প্রতিকার পাবে না। ঘুষ-দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারে সরকারযন্ত্র প্রায় অকেজো হয়ে যায়।

মেক্সিকোর সরকারযন্ত্র ঘুষ-দুর্নীতির জন্য অতীব খ্যাত। পুলিশে চাকরি নেয় ঘুষ দিয়ে, ঘুষ খাওয়ার জন্য। অথবা রাজনৈতিক বিবেচনায়। কোনো অপরাধ হলে শত শত লোকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবে এবং পরে জনপ্রতি ঘুষ আদায় করবে। মেক্সিকোর কথা বলছি, বাংলাদেশের না। আমাদের পুলিশ হিসাব দেয় না। দেশে কোন অপরাধ কতটা ঘটছে, তার হিসাব দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের একটা দপ্তর আছে। শ দেড়েক দেশ তাদের হিসাবনিকাশ পাঠায়। আমরা নিয়মিত পাঠাই না।

১০ বছর আগে, ২০০৫ সালে, ঢাকা শহরে কতজন খুন হয়েছিল তার হিসাব পুলিশের কাছে আছে। অধমের ধারণা, সংখ্যাটি ছিল শ ছয়েক। হলফ করে বলতে অবশ্যই পারব না। ধারণা থেকে বলছি। আজ ১০ বছর পর, শুধু পুলিশ বা সরকারই বলতে পারবে, সেই ৬০০ খুনের ঘটনায় কতগুলো খুনের মামলার বিচার হয়ে দোষীর শাস্তি হয়েছে। ৬০০টার মধ্যে অথবা সঠিক সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, খুব বেশি হলে ৬০টিতে, অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মামলায় খুনির শাস্তি হয়েছে বলে আমার ধারণা। ৩০টি খুনের সুরাহা হলে, খুনি বিচারে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে ৫ শতাংশ মামলায়। অথবা মেক্সিকোর মতো ২ শতাংশ হলে সর্বসাকল্যে ১২টি মামলায় বিচার হয়ে খুনির শাস্তি হয়েছে।

খুনের মামলায় বিচার হয়ে সাজা হওয়ার সংখ্যা যত কম, ঘুষের হার তত বেশি হওয়ার কথা। সংখ্যাগুলো পেলে ঘুষের হার অনুমান করতে পারতাম, সবাই পারত। কুমিল্লা পুলিশের হিসাব? কয়টা খুনের মামলার সুরাহা তারা করতে পেরেছে? তবে একটা হিসাব অনেক এনজিওর কাছে আছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত এক যুগে র‍্যাব-পুলিশের হাতে কত লোক নিহত হয়েছে। তনুর হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে, গ্রেপ্তার করে, বিচার করে, দণ্ডিত করলে যারপরনাই আনন্দিত হব। তবে প্রত্যাশা অত্যল্প। যদিও মাঠে নামা ছেলেমেয়েদের সাধুবাদ জানাই, তবু তাদের মনে করিয়ে দেব, দেশ উদ্ধার অত্যন্ত কঠিন কাজ। দিনের পর দিন লেগে থাকতে হবে। এক সপ্তাহে কিছুই হবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ করা, ন্যায়বিচার চাওয়াটাই রাজনীতি। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে জানলে সারা জীবন অন্যায়ের শিকার হবে। আইন আছে, থাকবে, তাতে কী!

২.

আইন আছে, তাতে কী! দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার দণ্ডাদেশ হয় গত ২৭ মার্চ। তাৎক্ষণিকভাবে অর্থাৎ ২৭ মার্চ সারা দিন ইলেকট্রনিকস মিডিয়া অর্থাৎ চ্যানেলগুলোতে বলে চলেছিলাম, অন্তত নৈতিক কারণে দুই মন্ত্রীই পদত্যাগ করবেন, করেননি। তাহলে এখন আইন দেখাই! একটু পেছনের কথা, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত’ কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা অন্য কোনো প্রশাসনিক শাস্তি দিতে হলে একটা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে বরখাস্তের শাস্তি দিতে হবে।

ধরেন, কোনো কর্মকর্তা দিনের পর দিন অফিসে আসেন না বা লেট করে আসেন বা অফিসে এসে এক বা দুই ঘণ্টা পরে উধাও। এ রকম কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ গঠন করতে হবে—আপনি কাজে আসেন না, দেরি করে আসেন, ইত্যাদি। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ অভিযোগের জবাব দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তারপর অভিযুক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর উপস্থিতিতে তাঁর বিরুদ্ধে সবকিছু প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া যাবে। যেমন নিচের পদে নামানো, বেতন কর্তন অথবা বরখাস্ত।

তবে কোনো কর্মকর্তা যদি ফৌজদারি অপরাধ করেন? ঘুষি মেরে বড় সাহেবের তিনটা দাঁত ফেলে দিলেন (গুরুতর শারীরিক জখম); অফিসের পাঁচটা কম্পিউটার গোপনে বাসায় নিয়ে গেলেন (চুরি); ঘুষ-দুর্নীতি, ইত্যাদি? তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা (ক্রিমিনাল কেস) হলো, বিচার হলো। তিনি দোষী প্রমাণিত হলেন। তিন বছরের জেল (কারাদণ্ড) হলো। জেলে গেলেন। এমতাবস্থায় সাজাপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত বা বরখাস্ত করতে কি প্রশাসনিক ব্যবস্থা শুরু থেকে শেষতক নিতে হবে?

অর্থাৎ ‘আপনার তিন বছর জেল হয়েছে অতএব আপনাকে কেন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না’-এ মর্মে কি নোটিশ জারি করতে হবে? না। এ জন্যই দ্য পাবলিক সার্ভেন্ট (ডিসমিস্যাল অন কনভিকশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ নামে একটা আইন আছে। এই আইনের মোদ্দাকথা (আইনটা ছোট্ট, দুই পৃষ্ঠার আইন) হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারীর যদি কোনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা হয় তাহলে ওই কর্মকর্তা/কর্মচারী আপনাআপনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন। দুই মন্ত্রীর জরিমানা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এক হাজারের বেশি। আইন বলছে, তাঁরা বরখাস্ত হয়ে গেছেন। আইন আছে, তাতে কী!

৩.

সমস্যাটা আরও গভীর। মন্ত্রীরা কেন পদ ছাড়তে চান না? পদ ছাড়ার পর তাঁরা অন্য কোনো পদ পান না বলেই। বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রথম আমলের (২০০৯-১৪) যেসব মন্ত্রী দ্বিতীয় আমলে মন্ত্রিত্ব পাননি, তাঁদের কোনো চাকরিবাকরি, পদ বা পেশা আছে বলে শুনিনি। বেশির ভাগ মন্ত্রীর বেলায় মন্ত্রিত্ব একমাত্র চাকরি। এই চাকরি চলে গেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই আইন থাকতে পারে, ন্যায়-নীতি-নৈতিকতা থাকতে পারে, কিন্তু পদ আমি ছাড়ব না।

৪.

তনুর জন্য শুধু না, ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হবে তরুণদেরই। মন্ত্রীদ্বয়কে পদত্যাগ করতে হবে।

অন্যথায়, আমরা আইন আছে, তাতে কী!—এমন একটি দেশে পরিণত হব।

ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।