এই যে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তারপর সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়, সেসব তদন্তের ফল কোথায় যায়, তা কেউই জানেন না
এই যে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তারপর সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়, সেসব তদন্তের ফল কোথায় যায়, তা কেউই জানেন না

মতামত

আইনের শাসনের অভাবেই এসব ‘দুর্ঘটনা’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত নয়। মানবিক বিবেচনায় তো আলোচনা হওয়ারই কথা; এ আলোচনার অন্যান্য কারণও আছে। এখন পর্যন্ত আমরা জানি না, এ ঘটনা আসলে সব মিলে কত প্রাণ সংহার করেছে। আহত ব্যক্তিদের কতজন শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ে জিতবেন, সেটাও জানা সম্ভব নয়। যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁদের কতজন পঙ্গু ও অসহায় হয়ে পড়বেন, তা অনুমান পর্যন্ত করা দুষ্কর। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনা—যাকে গণমাধ্যম এবং প্রচলিত আলোচনায় ‘দুর্ঘটনা’ বলা হচ্ছে—তা আসলেই যে দুর্ঘটনা নয়, সেটাও অনেকেই স্মরণ করিয়ে দেবেন।

তবে এটা অস্বীকারের উপায় নেই, বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তা আমাদের সবার জানা; এটাও আমাদের অজ্ঞাত নয়, এর দায় কার, কোথায়। পুরান ঢাকায় নিমতলীর রাসায়নিক কারখানা, লালবাগের প্লাস্টিক কারখানা, রূপগঞ্জ হাসেম ফুডসের কারখানা, বনানীর এফআর টাওয়ার কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন অথবা রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার মতো বড় ধরনের ঘটনার পাশাপাশি আরও অনেক ধরনের ‘দুর্ঘটনা’ থেকেই আমাদের জানার কথা।

একটু ভালো করে তাকালেই দেখা যায়, এসব ঘটনার মর্মমূলে আছে তিনটি বিষয়—প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি, জবাবদিহি প্রদর্শনের অভাব এবং আইনের শাসন না থাকা। প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি মানে কেবল দেশ শাসনের প্রতিষ্ঠান নয়, একটি দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণের জন্য, সংশ্লিষ্ট কারখানা বা ব্যবসায়ীদের ওপর নজর রাখার জন্য প্রতিষ্ঠান থাকার কথা; কেবল নামে নয়, কার্যকর প্রতিষ্ঠান যারা সব ধরনের প্রভাবের ওপরে উঠে আইন-নিয়ম পালনের বিষয়টি দেখবে, সে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে সে বিষয়ে যে কথা হয়েছে, তা-ও নয়। একটা ‘দুর্ঘটনা’ ঘটলে সেই সুনির্দিষ্ট ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকাই সবার কাজ হয়ে ওঠে। এটি কেবল যে একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ তা নয়, তা বুঝতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদেরা অনীহ।

বিএম কনটেইনার ডিপোর কথাই যদি বিবেচনা করি, তাহলে এটা বুঝতে সাহায্য করবে যে কী করে প্রতিষ্ঠান না থাকাটা এ ভয়াবহ অবস্থা অব্যাহত রাখছে। যাঁরা এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন, তাঁদের কি এটা জানার কথা ছিল না যে কোথায়, কীভাবে এই ডিপো তৈরি করা হচ্ছে? পরিবেশ দপ্তরের কি এই দায়িত্ব ছিল না এটা খবর নেওয়া যে এখানে কীভাবে রাসায়নিক দ্রব্য রাখা হচ্ছে? কারও কি জানার কথা নয় যে এখানে কী ধরনের জিনিস রাখা হচ্ছে? চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তর জানত না সেখানে বিস্ফোরক দ্রব্য আছে। তবে কার জানার কথা এই খবর? লক্ষ করে দেখুন, একেকটি ঘটনার পর আমরা জানতে পারি কার কী দায়িত্ব ছিল এবং কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। প্রতিষ্ঠান মানে তো দালানকোঠায় কর্মকর্তা আর কর্মচারী থাকা নয়, কাগজে আইন থাকাও নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কাজ করছে না, তার বাইরে যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাদের কী অবস্থা?

প্রতিটি কথিত ‘দুর্ঘটনার’ পরে মাতম ওঠে, কিন্তু জনপরিসরে সেই শোকের আয়ু খুব দীর্ঘ হয় না। যাঁরা নিকটজন হারান, যাঁদের শরীর ও মনে এ ঘটনার পরিণতি বহন করতে হয়, তাঁদের শোক শেষ হয় না, তাঁদের এ ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় সারা জীবন। বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, সে ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে না। কিন্তু আমাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া জরুরি যে শোক ও সান্ত্বনার এই বৃত্তচক্রের বাইরে গিয়ে আসলেই আমরা কিছু করতে চাই কি না।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন বলে যে সংগঠন আছে, তার প্রধান নুরুল কাইয়ূম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই শিল্পের [কনটেইনার ডিপো শিল্প] যাত্রা শুরুর ২৪ বছরে এত বড় দুর্ঘটনা আগে ঘটেনি। এর আগে ডিপোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে খুব দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল’ (প্রথম আলো অনলাইন, ৫ জুন ২০২২)। ‘ছোটখাটো’ এসব ঘটনার পর তাঁরা কী ধরনের নজরদারির ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, সেসব কথা জানার কোনো উপায় নেই।

এটা কেবল এই শিল্পের কথা নয়, অন্যান্য শিল্পের কথাও ভাবুন। সব শিল্পেরই এ ধরনের অ্যাসোসিয়েশন আছে, সেখানে নির্বাচন হয়, নেতা থাকেন, কিন্তু সেগুলো শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের নিরাপত্তা বিধান, মান বহাল রাখা কিংবা পরিবেশের ওপর তার প্রভাব বিষয়ে কিছু করেন বলে এমন খবর পাওয়া যায় না। যেকোনো ধরনের শিল্প বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপর নাগরিকদের হয়ে নজরদারির কাজ হচ্ছে সরকারের, সেটা সরকার করে না। আর ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো কেন তাদের দায়িত্ব পালন করে না, সে প্রশ্নও তোলা জরুরি। রাজনৈতিক বিবেচনায় সংগঠনের নেতা নির্বাচন এবং সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার কারণে এগুলো কয়েকজনের স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কিছু করতে উৎসাহী বলে মনে হয় না।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে জবাবদিহি প্রদর্শনের অভাব। দেশ এমন এক শাসনব্যবস্থায় উপনীত হয়েছে, যেখানে কেউ কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন কী করে এবং কেন তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বা অনীহ, সে প্রশ্ন ক্ষমতাসীনেরা করেন না। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান দিচ্ছে কেন, সে নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই, তার বদলে সেই লোকসানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নাগরিকদের ওপরে। তারপরও গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, দেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১১টি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। সরকার এক বছরে গচ্চা দিয়েছে ২৭১ কোটি টাকা। এ বছর বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি দেওয়া হবে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগ যাচ্ছে বসিয়ে রাখা ব্যক্তিমালিকানাধীন কুইক রেন্টালের ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’-এর জন্য। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তা ব্যাংকের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া আর জনগণের অর্থ ব্যাংকের হাতে তুলে দেওয়া। এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। এর কারণ হচ্ছে যাঁরা এসব সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁরা ক্ষমতাসীনদের কাছের লোক, ঘরের মানুষ।

এই যে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তারপর সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়, সেসব তদন্তের ফল কোথায় যায়, তা কেউই জানেন না। যারা গাফিলতি করল, তারা নামহীন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো—এমন ঘটনা ঘটে না। নাগরিকদের করা তদন্তের ফল সরকারের হাতে গেলেও সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এক বছর আগে হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত করে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছিল। সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এ ধরনের নাগরিক জবাবদিহি যে সরকারের অপছন্দ, সেটা প্রায়ই মন্ত্রীদের কথায় বোঝা যায়। টিআইবি যখনই প্রশ্ন করেছে, তার উত্তরে সরকারের প্রতিক্রিয়া এর বড় প্রমাণ।

তৃতীয় দিক হচ্ছে আইনের শাসন না থাকা। এসব ‘দুর্ঘটনায়’ যাঁদের দায়, তাঁদের একাংশ হচ্ছেন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আর যাঁরা মালিকশ্রেণি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ খুঁজতে দুরবিন অথবা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার। ধনসম্পদ এবং ক্ষমতাসীনদের নৈকট্য তাঁদের জন্য সুরক্ষাবর্ম হিসেবে কাজ করে। কেবল ‘দুর্ঘটনার’ ক্ষেত্রেই তা ঘটে না, সব বিষয়েই একই অবস্থা। আইনের চোখে নাগরিকের সমতার ধারণা এখন কার্যত কাগুজে বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা যে দায়মুক্তি পান, তা প্রতিদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সবার জন্য আইন সমান নয়। ফলে যখন এ ধরনের মর্মন্তুদ ঘটনার পরও কমবেশি সবাই জানেন, যাঁদের দায়, তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবেন।

প্রতিটি কথিত ‘দুর্ঘটনার’ পরে শোকের মাতম ওঠে, কিন্তু জনপরিসরে সেই শোকের আয়ু খুব দীর্ঘ হয় না। যাঁরা নিকটজন হারান, যাঁদের শরীর ও মনে এ ঘটনার পরিণতি বহন করতে হয়, তাঁদের শোক শেষ হয় না, তাঁদের এ ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় সারা জীবন। বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, সে ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে না। কিন্তু আমাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া জরুরি যে শোক ও সান্ত্বনার এই বৃত্তচক্রের বাইরে গিয়ে আসলেই আমরা কিছু করতে চাই কি না।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।