পৃথিবীতে দুই ধরনের খুন অবৈধ নয়। প্রথমটি হচ্ছে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। দ্বিতীয় বৈধ খুন হচ্ছে আত্মরক্ষার্থে কাউকে মেরে ফেলা। কিন্তু এর বহু শর্ত আছে বিভিন্ন দেশের ফৌজদারি আইনে।
আমাদের দেশের পেনাল কোডেও আত্মরক্ষার্থে খুনের কঠোর শর্ত রয়েছে। যেমন আমি এটি করতে পারব শুধু তখনই, যখন কেউ আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় এবং এটি প্রতিরোধে তাকে খুন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় না থাকে। আত্মরক্ষায় নরহত্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে সমানুপাতিক শক্তিপ্রয়োগের শর্ত। আমাকে একজন লাঠি দিয়ে মারতে এল, আমি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাকে মাথায় গুলি করতে পারি না। আমি প্রথমে তাকে অস্ত্র দেখিয়ে সতর্ক করব, ফাঁকা গুলি করব, তারপর প্রয়োজন হলে তার পায়ে গুলি করব। এসব শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাউকে মেরে ফেললে খুনের অভিযোগে এমনকি আমারই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে এসব শর্ত আরও কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। আইনে আত্মরক্ষার অধিকারের মধ্যে অন্যকে রক্ষার অধিকারও রয়েছে। এই ব্যাখ্যা বলে পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু আত্মরক্ষার্থে নয়, অন্যের জীবন ও সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় স্থাপনা রক্ষার জন্যও প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করা।
তবে এই শক্তি প্রয়োগ সব সময় আইনসংগতভাবে হয় কি না, এ নিয়ে সমাজে প্রশ্ন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সমাবেশ ও কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, আরও অনেকে আহত হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে হেফাজতের বিভিন্ন তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য অনেকগুলো মামলা হয়েছে, অনুমাননির্ভর বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, পুলিশের পক্ষ থেকে আরও কঠোরভাবে তাদের মোকাবিলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এসব তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞের সুষ্ঠু বিচার অবশ্যই করতে হবে, দোষী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু একই সঙ্গে পুলিশের গুলিতে সংঘটিত মৃত্যুর ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করার দায়দায়িত্ব সরকারের রয়েছে।
২.
বাংলাদেশের আইন পুলিশের শক্তি প্রয়োগ সমর্থন করে শর্ত সাপেক্ষে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৮ ধারায় পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ করে জননিরাপত্তার জন্য হুমকিমূলক সমাবেশ বা বেআইনি সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৩০(২) ধারায় এ কাজ করতে গিয়ে যতটা সম্ভব কম শক্তি প্রয়োগ ও যতটা সম্ভব জনতার কম ক্ষতি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলে (পিআরবি, ১৫৪-১৫৮ ধারা) পুলিশকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আত্মরক্ষা, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার কার্যকর করা—এই তিন ক্ষেত্রে। আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী সমাবেশ মোকাবিলায় এক্সট্রিম মেজার (চরমপন্থা) হিসেবে গুলি করার অনুমোদন রয়েছে, তবে এটি করা যাবে কেবল অন্য কোনোভাবে এমন সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা অসম্ভব হয়ে উঠলে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হলে তা নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্টভাবে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, পরিহারযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি না করার কথা বলা আছে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার যৌক্তিক ছিল কি না, সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী তদন্ত করার কথাও পিআরবিতে বলা আছে।
ঔপনিবেশিক আমলে করা এসব আইনের (পেনাল কোড, সিআরপিসি, পিআরবি) তুলনায় এ–সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন ও প্র্যাকটিস আরও কঠোর। ১৯৯০ সালের জাতিসংঘ আইন প্রয়োগাকারী সংস্থা কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কিত ২৬টি মূল নীতিমালা গ্রহণ করেছে। সেখানে বলা আছে, মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের অত্যাসন্ন হুমকি ছাড়া শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না, একেবারে অপরিহারযোগ্য (স্ট্রিক্টলি আনঅ্যাভয়েডেবল) ক্ষেত্রে অস্ত্র ব্যবহার করতে হলে মানুষের জীবনের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, যতটা সম্ভব কম ও আনুপাতিক শক্তি ব্যবহার করতে হবে, অস্ত্র ব্যবহারের আগে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়ার্নিং দিতে হবে এবং প্রথমে বিক্ষোভকারীদের জীবন রক্ষার্থে নন-লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করতে হবে। এতে সরকারকে অস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কিত বিস্তারিত গাইডলাইন প্রণয়ন, আহত ব্যক্তিদের দ্রুত ও উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শক্তি প্রয়োগের শিকার মানুষের প্রতিকার পাওয়ার আইনগত অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়।
উন্নত বিশ্বে শক্তি প্রয়োগ সীমাবদ্ধ করার জন্য পুলিশের বড় একটি অংশকে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদানই করা হয় না, উন্মত্ত সমাবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় লেস লেথাল বা নন-লেথাল (যেমন পেপার স্প্রে, অচেতন করার অস্ত্র, রাবার বুলেট এবং প্রবল ধোঁয়া ও শব্দ উৎপাদনকারী স্পঞ্জ গ্রেনেড) সরঞ্জাম দিয়ে। আমেরিকায় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ জনতাকে মোকাবিলায় পুলিশের গুলিতে কাউকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেনি। সেখানে অন্য একটি ঘটনায় ক্যাপিটল হিলে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পিকারসহ পুরো পার্লামেন্টের ওপর আক্রমণোদ্যত উন্মত্ত জনতাকে ঠেকাতে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এদের ঠেকাতে একজন পুলিশ অফিসারের মৃত্যু ও বহু পুলিশ আহত হয়। বিক্ষোভকারীদের সশস্ত্র আক্রমণ, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্পিকারকে প্রাণনাশের স্লোগান, পুলিশের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনাগুলোতে শক্তি প্রয়োগের ন্যায্যতার ইঙ্গিত ছিল, কিন্তু তাই বলে এতে চারজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর তদন্ত থেমে থাকেনি।
৩.
বাংলাদেশেও গুলিবর্ষণে পুলিশের দায়দায়িত্ব নিয়ে তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। গত কয়েক দিনে হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কখন ও কী পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি করেছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে গণমাধ্যমের বিবরণীতে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। যেমন হাটহাজারীতে হেফাজতের মিছিল থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপে থানার কাচ ভাঙচুরের ছবি আমরা দেখেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরে জানিয়েছেন, পুলিশের একজন ক্যাডেট এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। প্রশ্ন আসে, এসবের বিপরীতে পুলিশের গুলিবর্ষণে চারজনের মৃত্যু ও আরও বহু মানুষের আহত হওয়া কি সমানুপাতিক শক্তি প্রয়োগ ছিল? গুলি ছোড়ার আগে পুলিশ কি সতর্ক করেছিল, ফাঁকা গুলি করে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, গুলি কি শরীর বরাবর না করে পা বরাবর করার চেষ্টা ছিল?
আগের দিন বায়তুল মোকাররম এলাকায় পুলিশের অবিশ্রান্ত গুলি করার পরও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। প্রশ্ন আসে, হাটহাজারীতে কি চারজন মানুষের মৃত্যু এড়িয়ে বিক্ষোভ দমন করা যেত না? এর জের হিসেবে আরেকটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোলযোগ অনুমেয় ছিল। সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ ও বিজিবির সদস্য থাকা সত্ত্বেও প্রথমেই তারা সমাবেশ প্রতিরোধ করার পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে পুলিশের গুলিতে সেখানে ১৩ বা হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ১৫ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মাথায় পুলিশের গুলি খেয়ে মৃত্যুর অভিযোগও রয়েছে। পুলিশ এখানে সময়মতো পদক্ষেপ নিয়েছিল কি না, পরে পুলিশের শক্তি প্রয়োগ সমানুপাতিক ছিল কি না, এসব তদন্তের বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের আইনে রয়েছে। মোদির বিরুদ্ধে সমাবেশ করলে কলিজা ছিঁড়ে ফেলার হুমকি, পরে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ও ছাত্র অধিকার পরিষদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবলীলার আগের রাতে মাদ্রাসায় হামলার অভিযোগগুলোর তদন্ত করার দায়িত্বও আইনে রয়েছে। এসব দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে।
সর্বোপরি দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশকে আইনানুগভাবে কাজ করতে হবে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণে পুলিশের সামর্থ্য বাড়াতে হবে (যেমন পর্যাপ্ত নন-লেথাল বা লেস লেথাল সরঞ্জামের ব্যবস্থা), পর্যাপ্ত প্রিভেন্টিভ পদক্ষেপ (১৪৪ ধারা জারি, দলমত–নির্বিশেষে উসকানিদাতা বা সম্ভাব্য গোলযোগকারীদের আগেই গ্রেপ্তার) গ্রহণে নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, দাঙ্গা মোকাবিলায় পুলিশের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও মানবাধিকারসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, পুলিশ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাউকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে না। পুলিশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, কোনো সরকারের নয়। পুলিশের বেতন ও জীবিকা নির্বাহ হয় জনগণের টাকায়, দল বা সরকারবিশেষের টাকায় নয়। পুলিশের কোনো কর্তাব্যক্তির কথায় এসবের পরিপন্থী কোনো বক্তব্য না থাকা জরুরি। জরুরি গত কয়েক দিনে হেফাজতের তাণ্ডবলীলার বিচারের উদ্যোগের পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাসও। এই দায়িত্ব এড়িয়ে পুলিশ আরও কঠোর হবে—এ ধরনের বক্তব্য প্রদান বরং মানবাধিকার ও জননিরাপত্তাকে আরও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক