সিরিয়া ও ইরাক থেকে উৎখাত হয়ে আইএস এখন শাহেলে (আফ্রিকার একটি বড় অঞ্চল। উত্তরে সাহারা ও দক্ষিণে সুদান। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা) অঞ্চলে তাদের খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। স্বভাবগত ধরন অনুযায়ী পৃথিবীর সব অবৈধ সশস্ত্র গ্রুপ সুযোগসন্ধানী হয়ে থাকে। সাধারণত যেসব এলাকায় দারিদ্র্য থাকে, দুর্নীতি থাকে, ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সংঘাত থাকে এবং যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, মূলত সেসব জায়গাকেই এসব গ্রুপ তাদের অভিযান চালানো ও ঘাঁটি গাড়ার জায়গা হিসেবে বেছে নেয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থান।
ইরাকে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র অভিযান চালানোর পর থেকেই একের পর এক সংঘাত, সংঘর্ষ, জাতিগত দাঙ্গা ও বারবার সরকার পরিবর্তনের কারণে দেশটির অবস্থা খুবই খারাপ অবস্থায় এসেছে। দেশটির বহু ছোট ছোট এলাকায় নৈরাজ্য এত বেশি বেড়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। আর এটিকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে আইএস সেখানে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। তবে কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো এক হয়ে ইরাক ও সিরিয়া থেকে আইএসের ঘাঁটি উচ্ছেদ করতে পেরেছে। ইরাক ও সিরিয়ার কোনো শহরই আর আইএসের নিয়ন্ত্রণে নেই। গ্রুপটির যোদ্ধারা হয় নিহত হয়েছে, নয়তো ধরা পড়েছে কিংবা নিজেরা ধরা দিয়েছে। এ ছাড়া একটি বড় অংশ সেখান থেকে পালিয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের কথিত খেলাফতের পতন এবং সিরিয়ায় তাদের ‘খলিফা’ আবু বাকার আল বাগদাদি নিহত হওয়া সত্ত্বেও আইএস পৃথিবীর অন্যান্য অংশে গজিয়ে উঠছে। বিশেষ করে আফ্রিকার শাহেল অঞ্চলে তারা বেশ শক্তি নিয়েই মাথাচাড়া দিচ্ছে। এই অঞ্চলের আইএসের সাংগঠনিক নাম ‘দ্য ইসলামিক এস্টেট ইন দ্য গ্রেটার সাহারা (আইএসজিএস)’। এখানে তাদের শক্তি দিনকে দিন বাড়ছে। প্রতিনিয়ত তাদের সদস্যসংখ্যা বাড়ছে এবং তারা নিয়মিত ভিত্তিতে হামলা চালাচ্ছে।
পশ্চিম থেকে পূর্ব অর্থাৎ সেনেগাল থেকে সুদান পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে এই সন্ত্রাসী গ্রুপের জেঁকে বসতে পারার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশই জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাবে তীব্র দারিদ্র্যে আক্রান্ত। এসব দেশে খাবারের সংকট প্রকট। জাতিগত দাঙ্গা এখানে লেগেই থাকে। এখানে কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এখানকার মানুষের শিক্ষা গ্রহণ করা এবং পরিবার–পরিজন নিয়ে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করার মতো চাকরি–বাকরি পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। উপরন্তু স্থানীয় অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপের সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে সাধারণ মানুষ সব সময়ই তটস্থ থাকে। এখানকার উপকূল থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপের উপকূলে পাড়ি জমানোর জন্য বহু মানুষ এখানে জড়ো হয়। এসব কারণে আইএস তাদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য এই এলাকাকেই বেছে নিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার মতে, এই অঞ্চলভুক্ত বুরকিনা ফাসো ‘আরেক সিরিয়া’ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে।
পশ্চিম আফ্রিকার স্থলভাগবেষ্টিত এই দেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাসংকুল অবস্থায় আছে। সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী বোমা, রাস্তায় পেতে রাখা মাইন এবং ‘হিট-অ্যান্ড রান’ কৌশলের সমন্বয়ে হামলা চালিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়ে হাজার হাজার তরুণকে দলে ভিড়িয়েছে।
এসব সন্ত্রাসীর হামলার কারণে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে এবং দেশটির এক-তৃতীয়াংশ এলাকা লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে। বহু স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে বাচ্চারা লেখাপড়া করতে পারছে না। সর্বশেষ ঘটনায় গত ৬ নভেম্বর বুরকিনা ফাসোর পূর্বাঞ্চলে কানাডীয় সোনার খনি কোম্পানি সেমাফোর কর্মীদের বহনকারী একটি কনভয়ে সন্ত্রাসীরা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৩৭ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করে। এখন পর্যন্ত কোনো গ্রুপ এই হামলার দায় স্বীকার না করলেও বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এটি আইএসের কাজ।
শাহেল এলাকার সোনার খনির বিষয়ে আইএস এবং আল–কায়েদার আগ্রহ অনেক দিনের। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ২০১৬ সালের পর থেকে এই অঞ্চলের সোনার খনিগুলো সন্ত্রাসীরা দখল করে নিচ্ছে এবং এখানকার অর্থ দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করছে। তারা যত বেশি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর হচ্ছে, তাদের পক্ষে তত বেশি সদস্য জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে।
বুরকিনা ফাসোর এ অবস্থা এখন মালিতেও দেখা যাচ্ছে। গত মাসে সেখানে একটি সামরিক স্থাপনায় সন্ত্রাসী হামলায় ৫৩ জন নিহত হয়েছে। এই অঞ্চলভুক্ত নাইজারেও আইএসের উপস্থিতি বেড়েছে। দেশটির মালির সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় গত মে মাসে সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৮ জন নিহত হয়েছে।
বিশ্বনেতারা যখন সিরিয়ায় আইএসের উৎখাত নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তখন এ এলাকায় আইএস মাথাচাড়া দিচ্ছে। তা নিয়ে তারা এখনই সরব না হলে সামনে ঘোর বিপদ।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রশিদ আবদুল্লাহ: সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান সংঘাতবিষয়ক লেখক।