পাবলিক সার্ভিস দিবস

অহংবোধ যেন আমাদের গ্রাস না করে

তাঁরা সিভিল সার্ভিসের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাগত শ্রেষ্ঠত্বে গৌরবান্বিত বিভিন্ন ক্যাডারের ৮৫ জন সদস্য। বিপিএটিসিতে এটি তাঁদের প্রশিক্ষণের প্রথম পাঠ। আমন্ত্রিত হয়েছি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ওপর বক্তৃতা দিতে। তাঁদের বলেছি, স্বচ্ছতার মানে  ‘তোমার আচরণ, সরকারি দায়িত্ব পালন এবং সেবা প্রদান অবশ্যই জনগণের পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের অংশ।’ আর জবাবদিহি হলো, ‘তোমার বিবেক যেন থাকে সদা জাগ্রত, তোমার প্রতিদিনের দায়িত্ব পালন কতটা নির্ভুল, নির্মোহ ও ন্যায্য, তা জনগণের চোখে সন্তোষজনক প্রতীয়মান হতে হবে।’

 ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জনপ্রশাসন খাতের ব্যয় ৫৪ হাজার কোটি টাকা, যা সমগ্র বাজেটের সাড়ে ১৩ শতাংশ। দেখার বিষয় জনসেবার পরিমাণ ও গুণমান অর্থনীতির ভাষায় কতটুকু কস্ট-ইফেক্টিভ। জনগণের করের অর্থেই আমাদের বেতন-ভাতা এবং বিপরীতে মানুষ চায়, প্রশাসনের স্নেহে ও যত্নে মোড়ানো সেবা। নবীন কর্মকর্তারা সৌভাগ্যবান। কারণ, তাঁদের বেতনকাঠামো অনেক উন্নত। অথচ চাকরির দীর্ঘ সময় অনেক নগণ্য বেতন স্কেলেও আমরা বজায় রেখেছি দায়িত্ব পালনে অফুরন্ত প্রাণবন্ততা, মস্তিষ্কের কোষে প্রবেশ করেনি দুর্নীতির কল্পনা। অথচ চাকরির সূচনাতেই নবীন
কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ভুলে যাচ্ছেন পরিমিত ব্যয়ের জীবনধারা। একবার দুর্নীতির পথে গেলে প্রশাসনের নৈতিক কর্তৃত্ব বলে কিছু থাকে না।

নথির ঊর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী পরিভ্রমণের যে দীর্ঘসূত্রতা, তা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলায়তনের জন্মদাতা। সৎ, অকপট ও ইতিবাচক মন দিয়ে নথির জট খুলতে হবে। তথ্যের সামান্য ঘাটতি বা নগণ্য ভুলত্রুটির জন্য নথি ফেলে রাখা যাবে না। অফিস অনুশাসন শাণিত করতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার, মোবাইল ট্র্যাকিং, অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন, অনলাইন রিপোর্টিং, সিসিটিভি ক্যামেরা ইত্যাদি অব্যর্থ মহৌষধ। নিজেদের চার্টার অব ডিউটিজ এবং জনগণের চার্টার অব রাইটস বোঝাটাই আমলাতন্ত্রের (ব্যুরোক্রেসি) সার্থকতা। ‘মানুষ, মনুষ্যত্ব ও মানবতা’ হৃদয়ে না থাকলে আমলাতন্ত্র  ব্যর্থ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপান ও জার্মানির আমলাতন্ত্র সক্ষমতা ও পেশাদারি প্রমাণ করলেও ব্রিটিশরা অদক্ষ বলে নিন্দিত হয়েছে।

সততার জন্য পুরস্কার এবং দুর্নীতির জন্য শাস্তির চর্চা না থাকলে শুদ্ধাচারের প্রচেষ্টা বৃথা। আর্থিক সততাই একমাত্র সততা নয়। দুমুখো নীতি, পক্ষপাতদুষ্ট পলিসি বা আইন ভঙ্গের সংস্কৃতি ইত্যাদি ভিন্নমাত্রার দুর্নীতি। পুলিশ ও প্রশাসনকে ‘আমিত্ব’ ও ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ মানসিকতার ঊর্ধ্বে থেকে আনতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা। শোনা কথায় কাউকে শত্রু বানানো যাবে না, অহমিকাবোধ নিয়ে প্রতিপক্ষ ভাবা যাবে না, কানকথাকে প্রমাণ হিসেবে নেওয়া যাবে না। এক জেলার কর্ণধারের কাছে সম্প্রতি এক সেবাপ্রার্থীকে পাঠিয়েছিলাম তাঁর সমস্যাটি শোনার জন্য। তিনি সাক্ষাতের সময় তাঁকে বললেন, ‘মুনীর স্যার পাঠিয়েছেন বিধায় আপনাকে এত সময় দিয়েছি, নতুবা আমি কাউকে এত সময় দিই না।’ প্রতিবছর ২০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে যান। এরপর পার্থিব জীবন থেকে অবসরের ক্ষণ গণনা শুরু। এভাবে সিভিল সার্ভিসের গৌরবে অভিষিক্ত অতীতের বহু ডাকসাইটে কর্মকর্তা কালের পরিক্রমায় চির নির্জনতায় হারিয়ে গেছেন। আমরাও একদিন মানুষের স্মৃতির অগোচরে চলে যাব। সুতরাং এমন অহংবোধ যেন আমাদের গ্রাস না করে।

বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি, খাদ্যে ভেজাল, পরিবেশদূষণ, নদী ও জলাশয় দখল এবং সড়ক দুর্ঘটনা। এসব খাতে ৫০ শতাংশ অনিয়ম-দুর্নীতি কমানো যাবে ডিজিটালাইজেশনে, বাকি ৫০ শতাংশ কমানো যাবে আইনের শাসনে। নবীন কর্মকর্তা হিসেবে বুকে ধারণ করতে হবে দেশ, প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে। এসব অন্তরে স্থান না দেওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের (ইনস্টিটিউশনালাইজেশন) প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ছে। মানুষ পরিবেশ সুরক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা, নদ-নদী রক্ষা এবং সড়ক নিরাপত্তা দেখতে চায়। হাইকোর্টের অব্যাহত আদেশ সত্ত্বেও এখনো হাইড্রোলিক হর্ন চলছে দাপটে। রাজধানীতে কঠোর নির্দেশনা ভেঙে দিনে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অপচয় করে চলেছে ইজিবাইক। কী পরিহাস!

১০ বছর আগে মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে বিএসটিআইকে সিএনজি স্টেশনের গ্যাস চুরি বন্ধে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সিএনজি গ্যাস স্টেশনে নীরবে ক্রেতারা আজও ঠকছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট ২০১৭-এর গ্লোবাল র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও নামজারি, শিল্পকারখানা ও ভবন নির্মাণের অনুমতি, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া, ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে গ্রাহকদের অজস্র দুঃখগাথা। একটুকরো কাগজ বা অনুমতি পাওয়া যেন মরীচিকা। একেকটির অনুমোদনে প্রয়োজন ২৬৯ দিন থেকে ৩ বছর ১১ মাস পর্যন্ত সময়। কপালে ঘামের ফোঁটা এবং ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে মানুষকে যাতে সরকারি দপ্তরে আসতে না হয়, এর নিশ্চয়তাই সত্যিকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।

এক প্রকৌশলীর অবসর ভাতার নথি নিষ্পত্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা সময় নিয়েছেন মাত্র ১১ মাস (!)। দুর্ভাগ্য, অবসরপ্রাপ্ত ওই প্রকৌশলী দুই দফায় তিন লাখ টাকা ব্যয়ে লন্ডন থেকে দুবার আসা-যাওয়া করেছিলেন শুধু পাঁচ লাখ টাকা ভাতা পাওয়ার জন্য। দুদক থেকে কঠোর চাপ দিয়ে এ নথি আমাকে বের করতে হয়েছিল। এভাবে ফাইলবন্দী হয়ে থাকে অজস্র মানুষের ভাগ্য, জীবন ও জীবিকা। সিঙ্গাপুরে অনলাইন প্রক্রিয়ায় দাপ্তরিক সেবা মেলে মাত্র ১৫ মিনিটে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে একটি প্রশাসনিক ভুলের জন্য ১০০ ডলার জরিমানা দণ্ড পেতে হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে কত তুচ্ছ কারণে আইন আমাদের হাতে পদদলিত হয়। আসুন জেনে নিই রাজউক, নৌপরিবহন, বিআরটিএ, বিএসটিআইয়ের আইন ভেঙে যথাক্রমে কত অবৈধ ভবন নির্মাণ, জাহাজ ও যানবাহন চলাচল এবং কত প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এসবের উত্তর দিয়েই বিদ্যমান স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে। সিভিল সার্ভিসে এখন বেতন-ভাতা, পদোন্নতি ও যানবাহনের প্রচুর সুবিধা। সুতরাং জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবার জন্য চাই দক্ষতা, সততা ও নীতিনিষ্ঠা। মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের পদমর্যাদা ও ক্ষমতা ক্ষুদ্র ধূলিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র, নগণ্য। আজ জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উদ্‌যাপনকালে এ বাস্তবতা উপলব্ধির আহ্বান জানাই সব ক্যাডার, সংস্থা ও বিভাগের তরুণ কর্মকর্তাদের।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক