অস্ট্রেলিয়ায় লেবার সরকার: অভিবাসনে যে সুবিধা পেতে পারেন বাংলাদেশিরা

অস্ট্রেলিয়ায় বেশির ভাগ বাংলাদেশিই থাকেন দেশটির অন্যতম শহর সিডনিতে। এই সিডনিতেই কাছাকাছি তিনটি সংসদীয় এলাকার একটি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজি
ছবি: এএফপি

অস্ট্রেলিয়ায় নতুন সরকার এসেছে, সেটা কিছুটা পুরোনো খবরই বটে। প্রায় ১০ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি আবার ক্ষমতায় ফিরেছে। পার্টির নাম শুনেই কিছুটা আঁচ করা যায় দলটি শ্রমজীবী, মধ্যপন্থী–বাম। পাশাপাশি অভিবাসনবান্ধব ও সামাজিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী; যদিও অভিবাসনে বিমুখ ছিল না আগের লিবারেল পার্টির সরকারও। তবে লিবারেল সরকার অন্যান্য খাতের সঙ্গে অভিবাসন খাতেও এশিয়া-আফ্রিকার চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকামুখী বেশি ছিল। কিন্তু লেবার পার্টির অভিবাসন পদক্ষেপগুলো হয় ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চলনির্বিশেষে। আর এ কারণেই অভিবাসনবান্ধব হিসেবে সুনাম রয়েছে লেবার পার্টির। আর এই লেবার পার্টির সঙ্গে দীর্ঘদিনের একটা সখ্য রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম সমর্থকরাষ্ট্র ছিল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রথম এই অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ার লেবার সরকারের প্রধানমন্ত্রী গফ হুইটলাম। এরপর সেই অর্থে অস্ট্রেলিয়ার আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেননি। যদিও এবারের লেবার সরকারের প্রধান অ্যান্থনি অ্যালবানিজিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ আগেই জানিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

লেবার পার্টির জয় দেশটির বাংলাদেশি বাসিন্দাদের জন্য আনন্দের বিষয়। কারণ, দলটির সঙ্গে বাংলাদেশিদের ঘনিষ্ঠতা পুরোনো। অস্ট্রেলিয়ায় বেশির ভাগ বাংলাদেশিই থাকেন দেশটির অন্যতম শহর সিডনিতে। এই সিডনিতেই কাছাকাছি তিনটি সংসদীয় এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজি এবং আলোচিত নেতা ক্রিস বোয়েন্স ও টনি বার্ক। সিডনির বাংলাদেশি-অধ্যুষিত এলাকা ল্যাকেম্বার ফেডারেল সংসদ সদস্য হচ্ছেন টনি বার্ক। তিনি বর্তমানে লিডার অব দ্য হাউস এবং লেবার সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী।

এর আগে ২০১৯ সালের নির্বাচনে জোরালো সম্ভাবনা থাকার পরও হেরে গিয়েছিল লেবার পার্টি। আর তখনই তৎকালীন দলনেতা বিল শর্টেনকে সরাতে রব ওঠে। ফলে নতুন দলীয় প্রধান কে হবেন, এ প্রতিযোগিতায় দলের বাম-ডান-মধ্যপন্থী মিলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজি, ক্রিস বোয়েন্স ও টনি বার্কের নাম জোরেশোরে আলোচিত হতে থাকে। এর মধ্যে অ্যান্থনি অ্যালবানিজিই দলীয় প্রধান হয়ে এখন প্রধানমন্ত্রী। অ্যান্থনি অ্যালবানিজি, টনি বার্ক ও ক্রিস বোয়েন্সের সঙ্গে বাংলাদেশিদের ঘনিষ্ঠ আরেকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী হলেন অস্ট্রেলিয়াকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে বের করে প্রজাতন্ত্র করার দায়িত্বে থাকা ম্যাট থিসলেথওয়েট। তাঁরা সবাই স্থানীয় বাংলাদেশিদের কাছে খুবই পরিচিত এবং সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ। এই চারজনেই বাংলাদেশিদের অনেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণে এসেছেন বিগত বছরগুলোয়। এ ছাড়া লেবার পার্টির আরও কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতার সঙ্গে বাংলাদেশিদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশ থেকে চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সুযোগ বাড়ানোর অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা খাতেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ায় টেকনিক্যাল অ্যান্ড ফারদার এডুকেশন (টিএএফই) নামের যে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেটা বাংলাদেশে চালু হওয়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। এটা শুরু করার উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।

একুশের অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, তহবিল সংগ্রহ, রোজা, ঈদ, ইফতার, পূজা-পার্বণ, এমনকি আরও ছোটখাটো আয়োজনের প্রায় সব কমিউনিটিভিত্তিক অনুষ্ঠানেই স্থানীয় বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণে সাড়া দেন লেবার পার্টির এসব নেতা। এমনকি সিডনির প্রবীণ বাংলাদেশিদের ঘরোয়া নিমন্ত্রণেও আসা-যাওয়া রয়েছে তাঁদের। নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের কাউন্সিলর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন বহু বাংলাদেশি। তাঁদের মধ্যে নির্বাচিত বাংলাদেশি কাউন্সিলরের বেশির ভাগই লেবার পার্টির প্রার্থী।

লেবার সরকারের আমলে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বেশ কিছু সমস্যা নিরসনের চেষ্টা হতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রসেসিং কেন্দ্র দিল্লি থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আনা। অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ ভিসা আবেদন অনলাইনে সম্পন্ন করা যায়। তবে বেশ কিছু ভিসার ক্ষেত্রে ভিসা প্রসেসিং কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে হয়। আবার ঢাকায় থাকা কর্মকর্তা আর দিল্লিতে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক ফারাক ভিসা প্রাপ্তির ফলাফলে প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি লেবার-ঘনিষ্ঠদের চেষ্টায় এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। লেবার সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিরা যে সুবিধা পেতে পারেন, এর মধ্যে আরও থাকছে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে অগ্রাধিকারভিত্তিক সুবিধা, সমুদ্র গবেষণায় অস্ট্রেলিয়ার সাহায্য এবং অস্ট্রেলিয়ান বিনিয়োগ ও বাংলাদেশি পণ্যের অস্ট্রেলিয়ায় আমদানি বৃদ্ধি। বাণিজ্য খাতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ হাইকমিশনার ইতিমধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, যার ভিত্তিতে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশ থেকে চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও সুযোগ বাড়ানোর অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা খাতেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ায় টেকনিক্যাল অ্যান্ড ফারদার এডুকেশন (টিএএফই) নামের যে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেটা বাংলাদেশে চালু হওয়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। এটা শুরু করার উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
অভিবাসন খাতেও বড়সড় পরিবর্তন আশা করা হচ্ছে নতুন লেবার সরকারের কাছ থেকে। কেননা, ভিন্নতা দেখা গেছে লেবারের সরকার গঠনেও। নতুন সরকারে ১৩ নারী মন্ত্রী রয়েছেন। এ ছাড়া দেশটির ইতিহাসে প্রথম দুজন মুসলিম মন্ত্রী হয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওয়াং এশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম অস্ট্রেলিয়ান মন্ত্রী।

অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন নিয়ে নতুন কিছু পরিকল্পনা থাকছে লেবার সরকারের। অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসনে তিনটি প্রধান বিষয়ে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। শ্রমিকের ঘাটতি ও দক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের চাহিদা মেটানো। করোনা-পরবর্তী শ্রমের ঘাটতি পূরণের অস্থায়ী সমাধান হিসেবে দক্ষ অভিবাসীর ওপর নির্ভর করবে লেবার দরকার। স্কিলড মাইগ্রেশন ভিসায় (সাবক্লাস ১৯০) অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে। তবে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগে তেমন আগ্রহী নয় লেবার পার্টি। আর এ জন্যই তাদের দ্বিতীয় প্রধান পরিকল্পনা হতে পারে স্থায়ী ভিসাগুলোর প্রতি আকর্ষণ তৈরি করা। দক্ষ কর্মীদের অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করতে সুযোগ করে দিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের ভিসাগুলো সহজ করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অস্থায়ী সুযোগের প্রতি অনীহা থেকেই দেশটির শরণার্থীদের ওপর থেকে অস্থায়ী সুরক্ষা ভিসা স্কিম তুলে নিতে পারে লেবার সরকার।
বাংলাদেশের নাগরিকদের অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করা অধিক লাভবান বলে মনে করেন অনেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ও অভিবাসন খাতে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রবাসী রাজনীতিবিদদের পরামর্শ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্রুত সংলাপ ও বিশেষ চুক্তি করা দরকার। এ প্রক্রিয়ায় এখন অস্ট্রেলিয়ার নতুন সরকার থেকে বাংলাদেশিদের মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।

  • কাউসার খান অভিবাসন আইনজীবী ও সাংবাদিক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। kawsar.khan.au@gmail.com