অল্পতেই রেহাই পাবেন মুরাদ হাসান?

মুরাদ হাসান মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ায় প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দিত হয়েছেন। এর কারণ আছে। মুরাদ হাসানের অশ্লীলতা, রুচিবিকৃতি ও বেপরোয়া মনোভাবের যে পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল, এরপর মন্ত্রিসভায় তাঁর থেকে যাওয়া যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে যেত। এ অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ক্ষমতা ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি তা প্রয়োগ করেছেন। উঠতে-বসতে প্রধানমন্ত্রীকে মমতাময়ী মা ডেকে যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা আর ভোগ করতে পারেননি মুরাদ। এটি কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে জাতিকে।

কিন্তু এরপরও অমীমাংসিত রয়ে গেছে বহু প্রশ্ন। মুরাদ হাসান ডিজিটাল মাধ্যমে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর নাতনি আইনজীবী জাইমা রহমানকে নিয়ে চরম অশালীন ও মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছিলেন। এসব বক্তব্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট শুধু নয়, দণ্ডবিধি অনুসারেও ফৌজদারি অপরাধ। একজন চিত্রনায়িকার সঙ্গে তাঁর টেলিফোন সংলাপে রয়েছে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের (ধর্ষণের হুমকি ও অভিপ্রায়) উপাদান। হাইকোর্টের নির্দেশে অনুসন্ধানের পর ফেসবুক ও ইউটিউবে তাঁর প্রায় ৪০০ পোস্ট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেত্রীদের সম্পর্কেসহ) পাওয়া গেছে, যার মধ্যে রয়েছে অশ্লীল ও অশালীন বহু কিছু। মুরাদ হাসান কি এসবের জন্য বিচারের সম্মুখীন হবেন?

কোনো দেশে আইনের শাসন থাকলে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকার কথা ছিল না। আমাদের এখানে যে এই দুর্ভাগ্যজনক সংশয় রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে, কিন্তু এর ভিত্তিতে মামলা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া তিনি বিদেশে চলে গেলে মামলার তদন্ত বিঘ্নিত হতে পারে।

২.

মুরাদ হাসানকে নিয়ে আরেকটি যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। তাঁর প্রশ্ন, এমন একজন লোককে মন্ত্রী বানানো হয়েছিল কেন? মুরাদের রাজনৈতিক জীবন সাদামাটা, সুযোগ বুঝে ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে ঢোকার ঘটনায় তাঁর সুবিধাবাদী চরিত্রেরও বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো বহু ত্যাগী নেতার দলে এমন একটা মানুষকে কেন স্থান দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে সুলতানা কামালের মতো যে কারও বিস্মিত হওয়াই স্বাভাবিক।

তবে এর চেয়েও বিস্ময়কর সম্ভবত মুরাদ হাসানের এত দিন মন্ত্রিসভায় টিকে থাকাটা। একজন চিত্রনায়িকাকে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করার অভিপ্রায়ে তাঁর চরম অশালীন ও হুমকিমূলক যে অডিও রেকর্ড এখন ভাইরাল, তা দুই বছর আগের। এর মানে, অন্তত দুই বছর ধরে চরম অনৈতিক এক জীবন তিনি যাপন করে আসছিলেন। এই সময়ে তাঁর বেশ কিছু অশ্লীল পোস্টও ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তথা সরকারের উঁচু পর্যায়ের এসব না জানার কথা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব জানা থাকলে কেন বহু আগেই মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? আর মন্ত্রী পর্যায়ের লোকের এমন স্বভাবচরিত্র ও আচরণ সম্পর্কে জানা না থাকলে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা যায়।

মানুষ হুমকি পেলে পুলিশ-গোয়েন্দার কাছে যায়, জনগণের টাকায় এসব বাহিনীকে এ জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একজন মন্ত্রী ধর্ষণের জন্য কোনো নারীকে এসব বাহিনী দিয়ে তুলে আনার হুমকি দিলে ভুক্তভোগীরা যাবে কোথায়? সম্ভবত এ কারণেই, অত বড় অপরাধমূলক কাজের ভিকটিম হওয়ার পরও ওই চিত্রনায়িকাকে আমরা পুলিশের দ্বারস্থ হতে দেখিনি, এ সম্পর্কে কোথাও কিছু বলতে শুনিনি তখন।

৩.

মুরাদ হাসান সম্পর্কে আরও প্রশ্ন তোলা যায়। তবে তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রশ্নের উপাদান রয়েছে ওই চিত্রনায়িকার সঙ্গে ফাঁস হওয়া অডিওটিতে। তাঁর সঙ্গে মুরাদ হাসানের ব্যবহার ছিল অমানবিক ও বর্বরোচিত। তাঁকে একটি পাঁচতারা হোটেলে যেতে বাধ্য করার জন্য পুলিশ, ডিবি, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে দিয়ে তুলে আনার হুমকি দিয়েছিলেন মুরাদ হাসান।

সংবিধান অনুসারে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন এবং সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাযথ আচরণ করার শপথ নিতে হয়েছিল মুরাদ হাসানকে। চরম অবৈধ ও অনৈতিক কাজের জন্য এসব বাহিনীকে ব্যবহারের হুমকি তাহলে কোন সাহস ও অধিকারবলে দিতে পারেন তিনি? মানুষ হুমকি পেলে পুলিশ-গোয়েন্দার কাছে যায়, জনগণের টাকায় এসব বাহিনীকে এ জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একজন মন্ত্রী ধর্ষণের জন্য কোনো নারীকে এসব বাহিনী দিয়ে তুলে আনার হুমকি দিলে ভুক্তভোগীরা যাবে কোথায়? সম্ভবত এ কারণেই, অত বড় অপরাধমূলক কাজের ভিকটিম হওয়ার পরও ওই চিত্রনায়িকাকে আমরা পুলিশের দ্বারস্থ হতে দেখিনি, এ সম্পর্কে কোথাও কিছু বলতে শুনিনি তখন।

এ ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের মনে আছে, আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদনে খুনের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত (পরে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমাপ্রাপ্ত) সাবেক সেনাপ্রধানের এক ভাইকে আমরা র‌্যাব-পুলিশকে ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজ করানোর অহংকার করতে দেখেছি। এমনকি নারায়ণগঞ্জে এক কমিশনার কর্তৃক এভাবে মানুষ খুন করানোর ঘটনাও আমরা জানি। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় দায়িত্ব পালনরত একজন মন্ত্রীর মুখে এ ধরনের হুমকি বাহিনীগুলোর জন্য চরম মর্যাদাহানিকর। এটি যেকোনো সাধারণ মানুষের জন্যও অস্বস্তিকর।

একজন মন্ত্রীর পক্ষে কীভাবে এমন নৈরাজ্যমূলক হুমকি দেওয়া সম্ভব হলো, এর সুষ্ঠু তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। আইনের শাসন ও সুশাসন বিষয়ে ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে এটি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

৪.

মুরাদ হাসানের ঘটনায় এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। রাজনীতিতে অশ্লীলতা অতীতে একটা সময় বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো গুটিকয় রাজনীতিবিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে এর ব্যাপক বিস্তার হয়েছে, এমনকি উচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কথাবার্তায় শালীনতার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অমার্জিত বক্তব্যের অভিযোগ উঠেছে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে।

রাজনৈতিক নেতারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আক্রমণের শিকার হন। অবাধ বাক্‌স্বাধীনতার দেশে আমেরিকায় এই আক্রমণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে কখনো সীমাও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু রাজনীতিতে বা পাবলিক লাইফে না এসেও তাঁদের সন্তানেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণের শিকার হয়েছেন এবং সেটিও একজন মন্ত্রীর দ্বারা—এ নজির বাংলাদেশের মতো অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও আমরা দেখিনি আগে।

মুরাদ হাসানের আচরণে এটিও সীমাহীন পর্যায়ে দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। জাইমা রহমান রাজনীতিবিদ নন, আমরা কখনো রাজনৈতিক বিষয়ে দূরের কথা, জনপরিসরে তাঁকে কোনো কথা বলতে শুনিনি। এমন একজন পুরোপুরি ঘরোয়া নারী সম্পর্কে মুরাদ হাসানের বক্তব্য অকল্পনীয় মিথ্যাচার আর অশ্লীলতাপূর্ণ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতা জাইমা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের সরাসরি কোনো নিন্দা বা সমালোচনা করেননি। মুরাদ হাসান মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন, কিন্তু এর একটি কারণ এটিও কি না, তা–ও আমরা জানি না।

মুরাদ হাসানের সামান্য শাস্তি তাই রাজনীতিতে শালীনতা আনতে কোনো ভূমিকা রাখবে কি না সন্দেহ। তবে আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের সন্তান আছে, অনেকের আছে নাতি-নাতনি। ন্যূনতম শালীনতা রক্ষার দায়িত্ববোধ আর অশ্লীল কথাকে সমালোচনা করার সৎ সাহস সে কারণে হলেও তাঁদের থাকা উচিত।

৫.

খারাপ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোনো যায়। আবার এসব থেকে আরও খারাপ কিছু করার দুঃসাহস ও আত্মবিশ্বাসও পাওয়া যেতে পারে। মুরাদ হাসানের উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত শাস্তি হলে এর মধ্যে মঙ্গলকর বার্তা থাকবে। মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দায়মুক্তি দিয়ে রাখলে তা হবে না; বরং এরপরও অন্যরা তুলনামূলক সহনীয় পর্যায়ে অশ্লীলতা অব্যাহত রাখলে মুরাদের মৃদু শাস্তির ঘটনা দ্রুত অনুল্লেখ হয়ে যাবে।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক