মতামত

অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেল

প্রথমে যা সাবেক একই রাষ্ট্রের ও বর্তমানে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরোধ মনে হয়েছিল, তা ক্রমেই বৈশ্বিক রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র নাবিক হাদিসুর রহমানের মৃত্যুসংবাদ জেনেছি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মো. তায়েবকে নাগরিকত্ব প্রদানকারী দেশ ইউক্রেনের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের সংবাদও আমরা পেয়েছি। ২২ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তু প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।

তবে সম্মুখ সামরিক যুদ্ধ এখন আর জনপ্রিয় নয়। যুদ্ধবাজ দেশগুলোর নাগরিকেরাও জাতীয় পতাকায় মোড়ানো সৈনিকদের মৃতদেহ আর দেখতে চায় না। তা ছাড়া ইরাক, আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এসব দেশের নাগরিকদের যুদ্ধবিরোধী করে তুলেছে। তাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির শত আবেদন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় কোনো দেশ সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেয়নি। এখন যা হচ্ছে তা হলো প্রক্সি যুদ্ধ, পেছন থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহ এবং ভাড়াটে সৈনিকদের সে দেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তাই ইউক্রেনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ সামরিক যুদ্ধের পরিবর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের ধারণা, রাশিয়াকে অর্থনৈতিক যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারলে, রাশিয়া তাদের সামরিক অভিযান থেকে পিছু হটবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।

অর্থ ও অর্থনীতি

নিষেধাজ্ঞার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যার মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এগুলোর সম্পদ ও লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৩টি রুশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাদ যায়নি রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় সম্পদ তহবিল, অর্থ মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মার্কিন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডও প্রায় অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করেছে।

ব্যক্তি ও পরিবার

নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, নিরাপত্তাপ্রধান, সেনাপ্রধান, রুশ পার্লামেন্ট ও ডুমার সাংসদ, এক ডজনের বেশি পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ধনী ও প্রভাবশালী বিলিয়নিয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে। এসব ব্যক্তি, পরিবার ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, ব্যবসায়িক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমনকি সাধারণ রুশ নাগরিকের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের সীমা আরোপ করেছে ইইউ ও যুক্তরাজ্য।

সম্মুখ সামরিক যুদ্ধ এখন আর জনপ্রিয় নয়। যুদ্ধবাজ দেশগুলোর নাগরিকেরাও জাতীয় পতাকায় মোড়ানো সৈনিকদের মৃতদেহ আর দেখতে চায় না। তা ছাড়া ইরাক, আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এসব দেশের নাগরিকদের যুদ্ধবিরোধী করে তুলেছে। তাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির শত আবেদন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় কোনো দেশ সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেয়নি।

শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ

রুশ জ্বালানি কোম্পানি, রেল, পরিবহন ও টেলিকম কোম্পানিতে মার্কিন ঋণ ও লগ্নি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাতে রুশ প্রতিরক্ষা, মহাকাশ ও সামুদ্রিক খাতে উন্নত প্রযুক্তি স্থানান্তর না হয় এবং রুশ বাহিনীগুলোর আধুনিকীকরণ ব্যাহত হয়। রুশ এয়ারলাইনস ও ব্যক্তিগত জেটের ইইউ, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন আকাশসীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অন্যান্য বিধিনিষেধ

অন্যান্য বিধিনিষেধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কতিপয় রুশ ব্যাংকের সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল নেটওয়ার্কের (সুইফট) ব্যবহারের সুযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মালিকানাধীন বেলজীয় এ প্রতিষ্ঠান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ বার্তা বিনিময় সুবিধা প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী এর ৩ হাজার ৫০০ অংশীদার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০০টি দেশে ১১ হাজার ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনকে সেবা প্রদান করে থাকে।

বিধিনিষেধের লক্ষ্য ও ফলাফল

আর্থিক বিধিনিষেধের কারণে মার্কিন ডলার ও রুশ রুবলের বিনিময় হার ১ ডলারে ১৩১ রুবলে ঠেকেছে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুবলের বিনিময় হার স্থিতিশীল করার জন্য তাদের সুদের হার ৯ দশমিক ৫ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করেছে। এতে করেও রুবলের পতন ঠেকানো যায়নি। ব্যাংকগুলোতে রুবল ও ডলার উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে বলে জানা যায়। রুশ নাগরিকেরা নিত্যব্যবহার্য পণ্য মজুত করছে, তাই দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে প্রতিক্রিয়া

পিক ট্রেডিং রিসার্চের ভাষ্য অনুযায়ী, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে রুশ সামরিক অভিযানের পর গমের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ, ভুট্টার দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ, পাম ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ২০ ও ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। তামা, দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও নিকেলের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত।

বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া

নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়ার ওপর আরোপিত হলেও সে দেশের সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে, এমন সব দেশই কমবেশি এর কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ঋণপ্রাপ্তি, পণ্যমূল্য পরিশোধ এবং আমদানি ব্যাহত হওয়া। রাশিয়ায় তৈরি পোশাকের উঠতি বাজারে রপ্তানি ব্যাহত হবে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। অপরিশোধিত তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। একইভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গম, ভোজ্যতেল প্রভৃতির মূল্যবৃদ্ধিতে। ইতিমধ্যে স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আবার বিভিন্ন ধাতুর মূল্যবৃদ্ধি শিল্প উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া অনিবার্য হয়ে উঠবে।

যুদ্ধের আসল কারণ কী

রুশ পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে ইউক্রেনের জাতিগত নিপীড়ন ও ইউরোপীয় সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ন্যাটোতে যোগদানের ইউক্রেনের প্রচেষ্টার কারণে দেশটিকে নিরস্ত্র করার জন্য ইউক্রেনে হামলা চালানো হয়েছে। ইরাক যুদ্ধ যেমন কথিত পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য হয়নি, বরং দেশটির তেলসম্পদের কর্তৃত্বের জন্য হয়েছিল, তেমনি বর্তমান সংকটের মূল কারণও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের লড়াই। মার্কিন বর্তমান কর্তৃত্বের মূল উৎস হচ্ছে রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ডলারের ব্যবহার। চীন, রাশিয়া, ইরান ভেনেজুয়েলাসহ বেশ কয়েকটি দেশ বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলার থেকে সরে আসার জন্য চুক্তি করছে। ফলে রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ইউরো, ইয়েন ও চীনা রেনমিনবির ব্যবহার বেড়েছে। খোদ রাশিয়াই এখন চীনা মুদ্রায় তাদের রিজার্ভের এক অংশ ধারণ করছে। ফলে আইএমএর সূত্রে জানা যায় যে ২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ডলারের ব্যবহার ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ কী করতে পারে

সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের লড়াই আরও জোরদার হবে। ডলারের প্রাধান্য ক্ষুণ্ন করা ছাড়াও সুইফটের বিকল্প উদ্ভাবন এবং এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে বিবর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। জ্বালানিসহ পণ্যের মূল্যের অস্থিরতা থেকে রেহাই পেতে আপৎকালীন মজুত গড়ে তুলতে হবে। যেমন এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে এফএসআরইউর (ভাসমান জাহাজ) পরিবর্তে ভূমিতে এলএনজি সংরক্ষণ প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তির ওপর সাম্প্রতিক কালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা যাতে প্রসারিত না হয় এবং ইইউ ও যুক্তরাজ্য যাতে এতে যোগ না দেয়, সে জন্য দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে উদার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে।

সবশেষে, দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকট এ দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শিক্ষা হলো কেউ আমাদের নিরাপত্তা দেবে না, নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ