সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে একটি সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমেই দরকার ব্যাংক খাতে বড় সংস্কার। এই খাতটিতে সুশাসনের বড় ধরনের অভাব আছে। সম্প্রতি যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এই খাতকে সুশাসনের ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে দিয়েছে। যেমন, একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পর্ষদে দুজনের পরিবর্তে চারজন রাখার বিধান। আবার একই পরিবারের সদস্যরা ছয় বছরের পরিবর্তে নয় বছর পর্যন্ত পর্ষদের সদস্য থাকতে পারবেন। এগুলো ব্যাংক খাতের সুশাসনের ক্ষেত্রে মোটেই সন্তোষজনক নয়। এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বা পরিচয়ের সূত্র ধরে ঋণ দেওয়া এবং ঋণ আদায়ে নমনীয় ভাব দেখানো বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে ঋণখেলাপিদের বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে বাজেটে একটি দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
বেসরকারি বিনিয়োগ এখনো বেশ শ্লথগতিতে আছে। অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে বেশ কিছু সমস্যা আছে। যেমন জমিপ্রাপ্তিতে অসুবিধা, জ্বালানি সংকট, সড়ক–রেলসহ বিভিন্ন বড় অবকাঠামোর সমস্যা। অবকাঠামোর সমস্যা সমাধানে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো দ্রুত মানসম্পন্নভাবে শেষ করতে হবে। অবশ্য জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় বিদেশ থেকে এলএনজি আনা হচ্ছে। তবে সরবরাহ পর্যায়ে জ্বালানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীদের জমির সংকট দূর করতে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দ্রুত চালু করা দরকার।
বিনিয়োগ চাঙা রাখতে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা সহজ করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনে আমরা ১৭৬ নম্বরে আছি। এর মানে, ১৭৫টি প্রতিযোগী দেশ এখনো বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
নতুন অর্থবছরে নতুন ভ্যাট আইন হচ্ছে। ভ্যাট আইনের বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে। মূল আইনের ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার থাকছে না। একাধিক হার হচ্ছে। এটিকে আমি স্বাগত জানাই। কেননা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট একটু বেশি। এ ছাড়া টার্নওভার করের সীমাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা একটু স্বস্তি পাবেন। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো এ দেশের বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেওয়ার যোগ্য। তাদের কাছ থেকে কীভাবে ভ্যাট আদায় করা হবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন থাকলেও হিসাব রাখা হয় আলাদা খাতায়। অনেকে গ্রাহকদের ভ্যাটের রসিদ দেন না। এতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি হয়।
আমি মনে করি, আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করের ন্যূনতম আয়সীমা কিছুটা বৃদ্ধি করা উচিত। কেননা গত কয়েক বছরে এটি বৃদ্ধি করা হয়নি। তাই গত কয়েক বছরের মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করের জন্য ন্যূনতম আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা বাড়িয়ে পৌনে তিন লাখ টাকা বা তিন লাখ টাকা করা উচিত। এতে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
যদিও বাজেটে শেয়ারবাজার নিয়ে তেমন পদক্ষেপ নেওয়ার কিছু থাকে না। তবে শেয়ারবাজারের লভ্যাংশের আয়ের ওপর করমুক্ত রাখার সীমা ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা যেতে পারে। তবে বাজেট বক্তৃতায় দেশি–বিদেশি কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি দিকনির্দেশনা অর্থমন্ত্রীর দেওয়া উচিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা