মতামত

অভিজিতের খুনিদের খোঁজে পুরস্কার ঘোষণা কেন

অভিজিৎ রায়
অভিজিৎ রায়

বাংলাদেশে ২০১৫ সালে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের বাংলাদেশি শাখার হাতে নিহত হন লেখক অভিজিৎ রায়। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আওতাধীন ‘রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস’ (আরএফজে) অফিস পুরস্কার ঘোষণা করেছে। সোমবার এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, পুরস্কারের পরিমাণ ৫০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ৪২ কোটি টাকার বেশি। অভিজিৎ রায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় হামলায় তিনি নিহত যান। চাপাতির আঘাতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। হামলায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদও গুরুতর আহত হন। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় বলা হয়েছে, অভিজিৎ হত্যায় দণ্ডিত পলাতক সৈয়দ জিয়াউল হক, আকরাম হোসেনসহ জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য দিলে তাঁকে ৫০ লাখ ডলার দেওয়া হবে।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার অভিযোগে বাংলাদেশের একটি আদালত গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, জঙ্গিনেতা আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনানসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন এখনো পলাতক (কালের কণ্ঠ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।

২০১৫ সালে এই হত্যাকাণ্ডের পরই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পুরস্কার ঘোষণা করেছিল বলে জানা যায়, এখন তা আবারও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হলো। দুটি কারণে এ ঘোষণা আমাদের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণায় কেবল পলাতক ব্যক্তিদের কথাই বলা হয়নি, এমনভাবে বলা হয়েছে, যাতে তাঁরা ছাড়াও অন্যদের ব্যাপারে তথ্য চাওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, ঘোষণার বিষয়টি এমন এক সময়ে হয়েছে যখন বাংলাদেশের একটি এলিট বাহিনী র‍্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা নিয়ে দুই দেশের ভেতর একধরনের টানাপোড়েন চলছে।

প্রথম বিষয়টির গুরুত্ব এ কারণে যে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি এতে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং তাঁদের বিচার করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ২০১৯ সালে রাফিদা আহমেদ বলেছিলেন, সরকারের তদন্তের বিষয়ে তিনি আস্থাশীল নন। বিবিসির বাংলা বিভাগের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ওরা যে নাটক করছে, সেটা না করলেও আমি অবাক হতাম না’ (বিবিসি বাংলা, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। তদন্তের ব্যাপারে এই আস্থাহীনতার একটি অন্যতম কারণ সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক ব্যক্তির নাম শোনা যাচ্ছিল। তারপরও একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, ‘অপরাধীদের ধরার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে’; আবার অন্যদিকে বলা হচ্ছিল, ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে সরকারকে এগোতে হচ্ছে।’

গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতের রায়ের পর রাফিদা আহমেদ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর ফেসবুকে লিখেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার সময় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি লেখেন, ‘গত ছয় বছরে এই মামলার তদন্তকারী কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। যদিও আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং হামলার একজন ভিকটিম। জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রকাশ্যে মিথ্যা বলেছেন যে আমি সাক্ষ্য দিতে রাজি নই। আসল কথা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে সরকারের কেউ কিংবা প্রসিকিউশনের কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’ শুধু তা-ই নয়, তিনি ২০১৬ সালে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের পুলিশ ক্রসফায়ারের নামে জঙ্গি সংগঠনের উচ্চপর্যায়ের সদস্য মুকুল রানা শরীফকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে, যে কিনা আমাদের ওপর হামলাকারী জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিল। শরীফ পুলিশের হেফাজতে ছিল, তাকে কেন মারা হলো?’

অভিজিৎ হত্যার পর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এফবিআই যুক্ত হয় এবং ২০১৫ সালের ৫ মার্চ তাদের একটি দল ঢাকায় আসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এফবিআইকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, কারিগরি সহায়তা দেবে তারা। তবে দেশের পুলিশ-গোয়েন্দারাই যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি (বাংলা নিউজ ২৪, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। তবে এফবিআই বাংলাদেশের তদন্তকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে বলে জানা যায়। ২০১৫ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংগৃহীত আলামত এফবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করেছে। ডিবির তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এফবিআই আমেরিকার ল্যাবে এই আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে (জাগো নিউজ ২৪, ১১ মার্চ ২০১৫)। একই বছরের সেপ্টেম্বরে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ডিবির কাছ থেকে ১১ ধরনের আলামত নিয়েও এফবিআই কোনো রিপোর্ট দেয়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ফজলুর রহমান এই অভিযোগ করেন (বাংলা নিউজ ২৪, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। পরে এফবিআইয়ের সহযোগিতার ব্যাপারে আর কোনো তথ্য বা অভিযোগ জানা যায়নি।

বাংলাদেশে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হলেও এফবিআইয়ের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এই পুরস্কারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশে আছেন বলে ধারণা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি হচ্ছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক, মেজর জিয়া বলে যিনি পরিচিত। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, পলাতক জিয়া গোয়েন্দাদের নজরদারিতে আছেন (জনকণ্ঠ)। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারিতেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক কমান্ডার সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর জিয়াউল হক কঠোর নজরদারিতে আছে। গোয়েন্দারা তার গতিবিধি ফলো করছেন (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম)।’

২০২১ সালে জানা যায়, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, প্রায় এক দশকে তারা অন্তত চারবার জিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় তাঁর অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তবে তাঁকে গ্রেপ্তারে বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যান তিনি (নিউজ বাংলা টোয়েন্টিফোর, ৩১ আগস্ট ২০২১)।’

তবে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, ‘তাকে আমরা খুঁজছি। সে অত্যন্ত চতুর লোক। আমাদের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী সে হয়তো অন্য কোনো দেশে গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমাদেরও চেষ্টা অব্যাহত আছে, তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য এবং আইনে তার যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি কার্যকর করার জন্য।’

জিয়াউল হক ২০১২ সালে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে চাকরিচ্যুত হন, পরে তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীতে যুক্ত হন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে সংঘটিত ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তির কারণে একাধিক মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন।

সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক র‍্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে এই পুরস্কার ঘোষণার কোনো ধরনের যোগাযোগ আছে—এমন মনে করার কারণ নেই। কিন্তু ঠিক যখন এই নিয়ে দুই সরকারের ভেতরে একধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেই সময়ে এ বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া একেবারেই কাকতালীয় বলে মেনে নেওয়া কষ্টকর। তারপরও এ ধরনের তথ্য পেলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কী পদক্ষেপ নেবে, সেটা জানা নেই। অতীতে এমন উদাহরণ আছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ সংঘটনের পর দক্ষিণ এশিয়ার দেশে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ধরনের তথ্য পেলে তা বাংলাদেশ সরকারকে জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না, নাকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে, সেটা জানার উপায় নেই। কেননা, এর সঙ্গে নিরাপত্তার প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশের কোনো অপরাধীর ব্যাপারে, যিনি বাংলাদেশেই আছেন বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, তাঁর বিষয়ে এতটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার একধরনের প্রশ্নের জন্ম দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে তাতে এখন যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার কিছু বিষয় খোলাসা হতো।

আরএফজে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি সার্ভিসের সন্ত্রাসবিরোধী পুরস্কার কর্মসূচি। এটির গুরুত্ব বোঝা যায় এর উদ্দেশ্য এবং এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাঠামোর দিকে তাকালে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে দেশটির সম্পত্তি বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত কিংবা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত ব্যক্তিদের আটক ও বিচারে সহায়তা করতে পারে—এমন তথ্যের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এই পুরস্কার চালু করা হয়। এ পর্যন্ত এই পুরস্কার বাবদ ১৪৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। পুরস্কারের বিষয় মনোনয়ন দেয় একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি। এ কমিটিতে হোয়াইট হাউস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল, সিআইএ, আইন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, ট্রেজারি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা থাকেন।

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো