অভাবে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থী, সরকার কী করছে

যেসব স্থানে কায়িক শ্রম বিক্রি হয়, এ রকম সব জায়গায় শিশু-কিশোরদের চোখে পড়বে। এদের অধিকাংশই ঝরে পড়া
ফাইল ছবি

‘মাঝে মাঝে মায়ের কবর দেখতে বাড়ি যাই। কবর জিয়ারত করি। মসজিদে মিলাদ দিই।’ কথাগুলো বলার সময়ে ১৬ বছর বয়সী সাহাবুলের চোখে পানি টলমল করতে থাকে। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালে বজ্রপাতে মাকে হারিয়েছে। বাবা আরেক বিয়ে করেন। স্কুল পড়াও বন্ধ হয়। পরে হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। পড়ার টাকা জোগাড় না হওয়ায় বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দেয় সে। চোখেমুখে তার স্বপ্ন আছে। স্মার্টফোন নেই। তবে সেটি না কিনে সেই টাকায় সে গরু কিনবে। ছাগল কিনে একজনকে দেখাশোনার জন্য দিয়েছে। নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত বিয়ে করবে না বলেও পরিষ্কার জানিয়ে দিল। বাড়ি তার রংপুরের মিঠাপুকুরে। সে রংপুরে একটি হোটেলে কাজ করে। সেখানেই কথা হচ্ছিল।

আমাদের দেশে শিক্ষার্থী যারা ঝরে পড়ে, অনুসন্ধান করলে তাদের বিচিত্র সংকট সম্পর্কে জানা যায়। সব সংকটের মূলে অর্থাভাব। কারও বাবা নেই, কারও মা নেই, আবার অনেকের বাবা অসুস্থ। ফলে সামর্থ্যহীনতা কিংবা ঘরের হাল ধরতে ছাড়তে হয়েছে লেখাপড়া। এই সংখ্যা নেহাতই কম নয়। চরাঞ্চলে এই সংখ্যা বিপুল।

কদিন আগে মিঠাপুকুর উপজেলার শালবনে দুপুরে আগে চারজন কিশোরের সঙ্গে দেখা। বাড়িতে কাজ থাকায় ওই দিন স্কুলে যায়নি। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তারা। তাদের একজন রাশেদুল জানাল, অষ্টম শ্রেণিতে শতাধিক শিক্ষার্থী থাকলেও সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। মেয়েদের অর্ধেকের বেশি বিয়ে হয়েছে। অনেক বন্ধু ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতে চলে গেছে। শরিফুল নামের মাদ্রাসাপড়ুয়া শিক্ষার্থী বলছে, ওদের মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে মেয়েদের বিয়ে শুরু হয়। সিরাতুল মোস্তাকিম জানাল, তাদের স্কুলেও একই অবস্থা। আলাপ চলাকালে ওসমান গণি নামের একজন বয়স্ক ভ্যানচালক এলেন। তাঁর সন্তানসংখ্যা ১০। তাঁর সব সন্তানেরই বিয়ে হয়েছে আঠারোর আগে। এদের অল্প বয়সে বিয়ের প্রধান কারণ অর্থসংকট।

রংপুর শহরে এক মাছের বাজারে মাছ কাটছিল সজিব নামের এক কিশোর। পড়ালেখার কথা জানতে চাইলে বলল, ‘এলা আর পড়ি না। স্কুল বাদ। করোনার সময় কামোত আসছি, আর স্কুলোত যাই নাই।’ এক কিশোর রিকশাওয়ালা রংপুর কারমাইকেল কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে টাকার অভাবে। তার ছোট বোনের টিউশনির টাকা, বাড়িতে মা–বাবা তার ওর নির্ভরশীল। ছোট বোন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ওকে বিয়ে দেবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছে, নিজে লেখাপড়া বাদ দিয়েছে ছোট বোনের লেখাপড়ার জন্য। ওর পড়ালেখা চালাবে।

উন্নয়ন মানে দেশের গুটিকয় মানুষের উন্নয়ন নয়। গুটিকয় মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে গড় উন্নয়ন বিবেচনা করে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। উন্নত রাষ্ট্রের জন্য আমাদের গণ–উন্নয়ন চাই। সরকারকে গণ–উন্নয়নমুখী হতে হবে।

সম্প্রতি তিস্তা নদী সুরক্ষা আন্দোলনের কাজে গিয়েছিলাম তিস্তা তীরবর্তী রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে। সেখানে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, সেখানে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অত দূরে মেয়েদের যাওয়া কঠিন। চরাঞ্চলের হাজার হাজার শিশু তাই প্রাথমিকেই ঝরে পড়ে। যেহেতু মেয়েরা স্কুলে যায় না, তাই অলস বসে থাকার পরিবর্তে বিয়ে দিয়ে দেয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো উদ্যোগ নেই।

শহর-গ্রাম-চরাঞ্চল-দুর্গম এলাকা সর্বত্রই ঝরে পড়ছে প্রচুর শিক্ষার্থী। এ সংখ্যা নিঃসন্দেহে করোনাকলীন বেড়েছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য প্রতিদিন বাড়ছে, তাদের অগণিত নিম্নবিত্ত বিত্তহীন হয়ে পড়ছে। এসব পরিবারেও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়বে। বিশেষ করে যারা অতিদরিদ্র হচ্ছে, তাদের ঝরে পড়ার হার যেকোনো সময়ের ঝরে পড়ার হারকে হার মানাতে পারে।

বর্তমানে সরকার বড় বড় মেগা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনছি নিত্যদিন। নিম্নবিত্ত কিংবা বিত্তহীনদের দিকে সরকারের যে মনোযোগ একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু সেটি অপ্রতুল। সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ে সরকার যে বরাদ্দ দেয়, তা সামান্য। সেটি সরকার চাইলে বাড়াতে পারে। কিন্তু যে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে, তাদের বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ একেবারেই চোখে পড়ছে না।

সমাজে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিরও এটি একটি কারণ। যখন লেখাপড়া ও কাজ থাকে না, তখন কিশোরেরা বিভিন্ন অনৈতিক কাজ জড়িয়ে পড়ছে। সমাজে কিশোর মাদকাসক্তের সংখ্যাও প্রচুর। ঝরে পড়াদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। কিশোর অপরাধ দূর করতে হলেও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে হবে।

যেসব স্থানে কায়িক শ্রম বিক্রি হয়, এ রকম সব জায়গায় শিশু-কিশোরদের চোখে পড়বে। এদের অধিকাংশই ঝরে পড়া। শখ করে কেউ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে হোটেলে কাজ নেয় না, রিকশা চালায় না, ধান কাটে না, দিনমজুরি করে না। শখ করে মা–বাবারাও মেয়ের বিয়ে ১৮–এর নিচে দেন না। সরকারিভাবে এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ পরিসংখ্যান জরুরি। যার আলোকে সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের পথ সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে।

লেখায় উল্লিখিত শিশু-কিশোরদের সবারই অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ উন্নয়নে নেতৃত্ব দিতে পারে। সে জন্য দেশের সব শিশুর শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য-শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা উচিত। আমাদের সাংবিধানিক অধিকারকে গুরুত্ব দিলেও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান সম্ভব। এর জন্য সদিচ্ছা এবং কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।

উন্নয়ন মানে দেশের গুটিকয় মানুষের উন্নয়ন নয়। গুটিকয় মানুষের উন্নয়নের সঙ্গে গড় উন্নয়ন বিবেচনা করে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। উন্নত রাষ্ট্রের জন্য আমাদের গণ–উন্নয়ন চাই। সরকারকে গণ–উন্নয়নমুখী হতে হবে। তারই অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধ করতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক